একান্ত সাক্ষাতকার রাশেদা কে. চৌধুরী।নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন হলে শিক্ষা ব্যয়ের ওপর চাপ কমবে
রাশেদা কে. চৌধুরী গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক। ২০০৮ সালে, তিনি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা, মহিলা ও শিশু এবং সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ প্রণয়নে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র সমিতির সাবেক সভাপতি রাশেদা কে. চৌধুরী ১৯৫১ সালে সিলেটে জন্মগ্রহণ করেন।
এবারের আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে শিক্ষায় বিনিয়োগ। ইউনেস্কোর প্রকাশিত সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে দেশে শিক্ষার ব্যয়ের ৭১ শতাংশ পরিবার বহন করে। শিক্ষায় রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ কম হওয়ায় পরিবার কি এমন চাপে আছে?
রাশেদা কে চৌধুরী শিক্ষা ব্যয়ের এই চিত্র বেশ উদ্বেগজনক। ইউনেস্কো রিপোর্ট প্রকাশ করে, এটি কেবল একটি বাস্তবতা নয় – এটি একটি প্রবণতা হয়ে উঠেছে। এটা সত্য যে শিক্ষার ব্যয়ের ৭২ শতাংশ পিতামাতার পকেট থেকে যায়, মূলত শিক্ষায় কম রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগের কারণে। দ্বিতীয় কারণ হল রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ যেখানে হওয়া উচিত সেখানে নেই। তৃতীয় কারণ ছিল শিক্ষাব্যবস্থা মূলত পরীক্ষানির্ভর হয়ে পড়েছিল।
শিক্ষায় রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ কম মানে বাজেটে শিক্ষা খাতে কম বরাদ্দ?
রাশেদা কে চৌধুরী : বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। দীর্ঘদিন ধরে বরাদ্দ জিডিপির ২ থেকে আড়াই শতাংশের মধ্যে রয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্য এই খাতে জিডিপির অন্তত ৪ থেকে ৬ শতাংশ বরাদ্দ জরুরি। ইউনেস্কোও শিক্ষা খাতে জিডিপির ৬ শতাংশ বরাদ্দের সুপারিশ করেছে। আমরা প্রায়ই শিক্ষা খাতে অনুদান বরাদ্দ দেখতে পাই। করোনার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষা খাত। তখন শিক্ষকদের সামান্য ভাতা দেওয়া ছাড়া এ খাতে বিশেষ কোনো বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। তবে অন্যান্য প্রায় সব খাতে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার কতটা ক্ষতি হয়েছে তা নির্ধারণ করা হয়নি; একইভাবে, লোকসান প্রশমনে বিনিয়োগ দৃশ্যমান ছিল না। মানব সক্ষমতা বৃদ্ধির খাত এভাবে অবহেলিত থাকলে ভবিষ্যতে গার্মেন্টসের মতো অন্যান্য খাতেও দেশের বাইরে থেকে দক্ষ জনশক্তি আনতে হবে। এই সুপারিশ করা হয় না।
করোনায় ঝরে যাওয়া শিশুরা ফেরেনি। শিক্ষা খাতে এমন প্রণোদনা পেলে আমরা কি দরিদ্র পরিবারের এই শিশুদের একটি অংশকে ফিরিয়ে আনতে পারতাম না?
রাশেদা কে. চৌধুরী: করোনা মহামারীর সময়ে বিপুল জনগোষ্ঠী খাদ্য ও আয় নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে। সে সময় অনেক সচ্ছল পরিবারও আর্থিক সংকটে পড়ে। দরিদ্র পরিবারের কথা না বললেই নয়। এজন্য অনেক দরিদ্র পরিবার তাদের সন্তানদের কাজে লাগিয়েছে। এই সময়ে অনেক স্কুলগামী মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। প্রণোদনার মাধ্যমে যারা শ্রমবাজারে যোগ দিয়েছিলেন তাদের ফিরিয়ে আনা কঠিন হতো না, কিন্তু তা করা হয়নি।
দ্বিতীয় যে কারণে আপনি শিক্ষা ব্যয়ের কথা বলেছেন তা হল বিনিয়োগ যেখানে হওয়া উচিত সেখানে হচ্ছে না…
রাশেদা কে. চৌধুরী: শিক্ষার চাহিদা স্থানভেদে ভিন্ন। যেমন, মেট্রোপলিটন শহরে শিক্ষার অবকাঠামো চর-হাওর বা প্রত্যন্ত অঞ্চলের মতো নয়। এসব এলাকার চাহিদা অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। একটি ‘মিড-ডে মিল’ বা মিড-ডে মিল দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীদের জন্য অনেক সাহায্য করতে পারে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০২৪ সালের মধ্যে মিড-ডে মিলকে সার্বজনীন করার ঘোষণাও দিয়েছিলেন। কিন্তু তারপরে করোনা এলো, তাই বাস্তবায়নে কোনো অগ্রগতি হয়নি।
সরকার প্রতি বছর বিনামূল্যে যে পাঠ্যবই সরবরাহ করছে তাতে পরিবারগুলো কতটা উপকৃত হচ্ছে?
রাশেদা কে. চৌধুরী: বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক নিঃসন্দেহে শিক্ষার্থী ও পরিবারের জন্য স্বস্তির বিষয়। প্রতি বছর শিক্ষার্থীরা নতুন বই পাচ্ছে যা তাদের পড়াশোনার জন্যও একটি বড় প্রণোদনা।
দেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থী প্রাথমিক স্তরে সরকারি স্কুলে পড়ালেখার কারণে এখানে পারিবারিক খরচও কম। অনেকে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও পড়াশোনা করছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় চাহিদা কতটুকু পূরণ করছে?
রাশেদা কে চৌধুরী : শিক্ষার উন্নয়নে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এ পর্যায়ে শিক্ষা সরকারী বিধি-বিধানের আওতায় থাকায় এক ধরনের শৃঙ্খলা বিরাজ করছে। কিন্তু মান নিয়ে প্রশ্ন আছে। শিক্ষার্থীদের যে দক্ষতা অর্জন করার কথা তা পুরোপুরি অর্জিত হচ্ছে না। বিষয়গত দক্ষতা ঘাটতি থেকে যায়। নতুন কারিকুলাম সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে সেই সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হতে পারে।
মাধ্যমিক স্তরে অভিভাবকদের শিক্ষা ব্যয় বেশি। আপনি তার জন্য শিক্ষা জাতীয়করণের দাবি করেছিলেন। শিক্ষার খরচ কমানো কতটা গুরুত্বপূর্ণ?