বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন।আমানতের অর্থে উত্তরা ফিনান্সের স্বেচ্ছাচার
গ্রাহকের জমানো টাকা হিসাবে জমা হয়নি।ঋনের তথ্যও গোপন করা হয়েছে। একজন পরিচালক কলমাণীর কাছ থেকে ধারের টাকা ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করেছেন। পরিচালকদের অনুমোদন ছাড়াই শেয়ার বাজারে বিনিয়োগের জন্য অর্থ প্রদান করা হয়েছে। ব্যবস্থাপনা পরিচালক কোটি কোটি টাকা নিয়ে তাদের কাজে লাগিয়েছেন। এভাবে আমানতকারীদের অর্থ নির্বিচারে উত্তরা ফিনান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডে স্থানান্তরিত হয়েছে। নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং আরও কিছু পরিচালক বিভিন্ন সময়ে ৩,৪৪০ কোটি টাকা বের করে ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহারের করেছেন।
২০১৯ সালের উত্তরা ফিনান্সের নিরীক্ষিত আর্থিক বিবৃতি পরিদর্শন করতে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক এই গুরুতর অনিয়ম পেয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তিন সদস্যের তদন্তকারী দলটি চার মাসের পরিদর্শন শেষে সম্প্রতি এই প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। জানা গেছে, গত সেপ্টেম্বর মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা এই পরিদর্শন বন্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের হস্তক্ষেপে এই পরিদর্শন শেষ হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদন অনুযায়ী উত্তরা ফিনান্সের বার্ষিক হিসাব বিবরণীতে ইজারা ফিনান্সিং বা ঋনের সম্পর্কিত তথ্য দেওয়া হয়েছে ১,৮০৩ কোটি টাকা। তবে ব্যাংকের লেজার ব্যালান্স রিভিউতে ৮০২ কোটি ৩৮ লাখ টাকার তথ্য পাওয়া গেছে। আবার, আর্থিক বিবরণীতে ১,৮৭৭ কোটি.২১লাখ টাকার মেয়াদী আমানত দেখানো হয়েছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক ২,৬০৩ কোটি ২০ লাখ টাকার মেয়াদী আমানতের তথ্য পেয়েছে। এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের আমানত ও ঋনের আসল তথ্য গোপন করে গোপনে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থাকে অর্থ প্রদান করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকৃত আমানত দায়বদ্ধতা এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য গোপন করে দীর্ঘদিন ধরে সংস্থাটি অবৈধ আর্থিক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল বলে পরিদর্শন দলটি মন্তব্য করেছেন।
পরিদর্শন অনুযায়ী, সংস্থার নিরীক্ষিত আর্থিক বিবরণী মার্চেন্ট ব্যাংকিং ইউনিটকে মার্জিন ঋনএবংঋন হিসাবে ৫৯৭ কোটি টাকা দেখিয়েছে, যার মধ্যে কোনও গ্রাহক-ভিত্তিক বিবরণ শ্রেণিবদ্ধ ঋনের বিবৃতিতে অন্তর্ভুক্ত নয়। অনুমোদন ছাড়াই সহায়ক সংস্থা উত্তরা ফিনান্স অ্যান্ড ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্টকে ২৪৮ কোটি টাকার মার্জিন ঋন দেওয়া হয়েছে। এই তালিকাটি কোনও তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কেনার জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল কিনা তা সংস্থাটি বলতে পারেনি। বাকি ৩৫০ কোটি টাকা স্ব-আগ্রহী সংস্থার পক্ষে সংস্থার পরিচালকদের কাছে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আরও ১৭৩ কোটি টাকা এবং পাঁচ লাখ এবং ৫২১ কোটি টাকা সরাসরি কোনও আবেদন, প্রস্তাব বা অনুমোদন ছাড়াই পরিচালকদের দেওয়া হয়। এভাবে আমানতকারীগণসহ সকল স্টেকহোল্ডারের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংস্থাটির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট অনিল চন্দ্র দাস অবৈধ আর্থিক কার্যক্রম সম্পর্কিত বেশিরভাগ চেক সই করেছেন। ১৯ জুন, ২০১১-এ যখন তিনি নিয়মিত চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন, তখন তাঁর মেয়াদ দুই বছর বাড়ানো হয়েছিল। তবে বোর্ড সভার কোনও প্রস্তাবই তার পক্ষে পাওয়া যায়নি। তারপরে এমডি শামসুল আরেফিনের অবিরাম অফিস নোটে অনিল চন্দ্র তার মেয়াদ পাঁচ বছরের জন্য বাড়ানোর প্রস্তাব করেন। বোর্ড চেয়ারম্যান রাশেদুল হাসান দুই বছরের জন্য অনুমোদন করেন। পরে, এমডি তার মেয়াদ ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮ অবধি বাড়িয়েছিলেন। তার পরে তার মেয়াদ বাড়ানো হয়নি, তিনি নিয়মিত কর্মকর্তা হিসাবে সব কিছুতে স্বাক্ষর করছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন থেকে প্রাপ্ত তথ্যের বিষয়ে মতামত জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এর নির্বাহী পরিচালক মো:ইফতেখারুজ্জামান বলেন যে এখানে আর্থিক অনিয়ম ছিল। একই সাথে মানি লন্ডারিংয়ের অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। এই জাতীয় অপরাধ প্রকাশের জন্য বাংলাদেশ ব্যাঙ্ককে ধন্যবাদ। তবে কেবল তথ্য প্রকাশ করা নয়, সর্বস্তরের লোকদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা গ্রহণও করা হচ্ছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্ত করা উচিত এবং যারা জনগণের অর্থ নিয়ে খেলেন তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।