পরীক্ষামূলক ইঞ্জিনে চলছিল ‘অভিযান-১০’।ধাপে ধাপে অব্যবস্থাপনা ও অবহেলা
চলন্ত এমভি অভিযান ১০’ লঞ্চে ব্যাপক প্রাণহানির পর জাহাজটির অব্যবস্থাপনার চিত্র বেরিয়ে আসছে। গত বৃহস্পতিবার দুপুর আড়াইটার দিকে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীর মাঝখানে অগ্নি নিরাপত্তায় বড় ধরনের অবহেলায় পুরো লঞ্চটি কাঠকয়লায় পরিণত হয়। অন্তত ৩৮ জন নিহত হয়েছে যা “আগুনের ভয়াবহতা” নামে পরিচিত।
অব্যবস্থাপনা ও অগ্নিকাণ্ডের সময় লঞ্চের ক্রুদের অবহেলা ও অসহযোগিতা যাত্রীদের বক্তব্যে স্পষ্ট। এ ঘটনায় কর্মরত তদন্ত কমিটি শনিবার পুড়ে যাওয়া লঞ্চটি পরিদর্শন করে অব্যবস্থাপনা ও গাফিলতির নানা চিহ্ন পায়।
অগ্নিকাণ্ডের কারণ ও ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে গতকাল থেকে কাজ শুরু করেছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সাত সদস্যের একটি কমিটি। এ ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে। তদন্তের ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো বলছে, এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে ইঞ্জিন রুমের ত্রুটির কারণে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে, যা লঞ্চের ক্রুরা শুরুতেই নিভিয়ে ফেলতে পারলে এত বড় ক্ষতি হতো বলে তারা মনে করেন না। . এ ক্ষেত্রে লঞ্চের কর্মীদের বড় ধরনের গাফিলতি ছিল।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, যে ইঞ্জিন রুম থেকে আগুন লাগার কথা ছিল সেটি রি-কন্ডিশনড (পুরাতন)। ত্রুটির কারণে আগের ইঞ্জিন সরিয়ে গত অক্টোবরে সেখানে দুটি নতুন ইঞ্জিন বসানো হয়। তবে ইঞ্জিনগুলো ভালোভাবে কাজ করছিল না এবং পরীক্ষা চলছিল। এরই মাঝে ইতিহাসের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে যাত্রীবাহী জাহাজে। নতুন ইঞ্জিন বসানোর বিষয়ে নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরকে জানানোর নিয়ম থাকলেও লঞ্চের মালিক সে পথ অনুসরণ করেননি। অধিদপ্তরের পরিদর্শকরাও বিষয়টি জানতেন না।
তদন্ত কমিটিতে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের মুখ্য যুগ্ম সচিব মো. তোফায়েল ইসলাম বলেন, শনিবার তারা পুড়ে যাওয়া লঞ্চটি পরিদর্শন করেছেন। তিনি সন্দেহজনক বিষয়গুলো খতিয়ে দেখেছেন। তিনি হাসপাতালে গিয়ে বেঁচে যাওয়া যাত্রী ও লঞ্চের ক্রুদের সঙ্গে কথা বলেন। মনে হচ্ছে ইঞ্জিনের ত্রুটির কারণে ইঞ্জিন রুম থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে। এখন তা এত দ্রুত কীভাবে ছড়িয়ে পড়েছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পুরো তথ্য বিশ্লেষণ ও যাচাই-বাছাই শেষে মূল কারণ বলা যাবে। সেই লক্ষ্যেই তারা কাজ করছেন।
তদন্ত কমিটির অন্তত দুই সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ত্রুটিপূর্ণ ইঞ্জিন দিয়ে লঞ্চটি চালানো হচ্ছে। সেখানে নতুন ইঞ্জিন বসানো হলেও লঞ্চটি যাত্রীদের নিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে চলছে। লঞ্চ কর্তৃপক্ষ জেনেশুনে এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজটি করেছে। এখানে গাড়ি কতটা দায়ী তা যাচাই করা হচ্ছে।
তদন্ত দলের সদস্যরা জানিয়েছেন, তারা বেশ কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী যাত্রীর সঙ্গে কথা বলেছেন, তাদের বক্তব্য নিয়েছেন। মনে হচ্ছিল, শুরুতেই লঞ্চটি তীরে এসে পড়লে এত হতাহতের ঘটনা ঘটত না। বেঁচে যাওয়া কয়েকজন যাত্রী জানান, আগুন লাগার পর লঞ্চটি তীরে পৌঁছাতে এক-চতুর্থাংশের বেশি সময় লেগেছিল।
ইঞ্জিন রুমের দায়িত্বে থাকা কয়েকজন লঞ্চের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ইঞ্জিন রুমে মাঝেমধ্যেই ছোট ছোট আগুন লেগেই থাকে। তারা এটাকে স্বাভাবিক হিসেবে দেখছেন। তাও সঙ্গে সঙ্গে নিভে যায়। তবে ‘অভিযান-১০’ লঞ্চের ইঞ্জিনে অতিরিক্ত তাপ উৎপাদনের কারণে আগুন ধরে যেতে পারে। ইঞ্জিন ভালো অবস্থায় থাকলেও ইঞ্জিনের নিষ্কাশন, সি পানির চাপ, ইঞ্জিনের কম্প্রেশন, ব্যাটারির তারের সংযোগ ঢিলে হলে বা ব্যাটারিতে ত্রুটি থাকলে আগুনের স্ফুলিঙ্গ তৈরি হতে পারে। ইঞ্জিন রুমে তাপমাত্রা বেশি থাকলে সেখান থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়তে পারে।
প্রায় এক মাস ধরে পরীক্ষামূলক ইঞ্জিনে যাত্রী তোলা হচ্ছিল : সদরঘাটে লঞ্চ মালিক সমিতি ও বিভিন্ন লঞ্চ শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বছর ‘অভিযান-১০’ লঞ্চটি চালু হয়। তবে ওই বছর করোনার কারণে যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে তা আর চলতে পারেনি। লকডাউন শুরু হলে ঢাকা-বরগুনা সড়ক চলাচল শুরু হলেও ইঞ্জিন ঠিকমতো কাজ করছে না। গতির অভাবে চাহিদা অনুযায়ী সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছাতে পারিনি। এরপর লঞ্চটিতে নতুন ইঞ্জিন বসানো হয়।
লঞ্চটির মালিক মেসার্স আল আরাফ অ্যান্ড কোম্পানি। আরও দুটি লঞ্চ পরিচালনা করে কোম্পানিটি। কোম্পানির ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়, ইঞ্জিন ঠিকমতো কাজ না করায় লঞ্চটি দ্রুত এগোচ্ছে না। ফলে যাত্রী হারানোর আশঙ্কা করছেন তারা। পরে মালিক ইঞ্জিন পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন। গত মাসে লঞ্চটি মাদারীপুরের একটি ডক ইয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হয়। দুটি রিকন্ডিশন্ড জাপানি ডাইহাতসু সামুদ্রিক ইঞ্জিন রয়েছে যা আগের ইঞ্জিনের চেয়ে বেশি শক্তিশালী (হর্সপাওয়ার)। গত ডিসেম্বরে ঢাকা-বরগুনা রুটে লঞ্চটি নিয়মিত চলাচল শুরু করলেও আবারও সমস্যা দেখা দেয়। এ কারণে পরীক্ষামূলক সফরে দুইজন সার্বক্ষণিক টেকনিশিয়ান লঞ্চটিতে ছিলেন।