বিশেষ ঋণ নিয়েও দুর্বল ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট অব্যাহত
গতকাল দুপুর সোয়া ২টার দিকে রাজধানীর দিলকুশায় ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের শাখায় প্রবেশ করলে ক্যাশ কাউন্টারের সামনে গ্রাহকদের ব্যাপক ভিড় লক্ষ্য করি। সবাই নগদ টাকা তুলতে এসেছিল। তবে এই শাখা থেকে কোনো গ্রাহক ১০,০০০ টাকার বেশি তুলতে পারেননি।
সোহরাব হোসেন নামের এক গ্রাহক বলেন, এই শাখার গ্রাহকরা ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা তুলতে পারবেন। আর অন্য শাখার গ্রাহকরা ৫ হাজার টাকার বেশি তোলার চেষ্টা করলে চেক ফেরত দিচ্ছেন। বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে ব্যাংক ম্যানেজারের কক্ষে যেতেই বেশ কয়েকদিন আগে ম্যানেজারের কক্ষের প্রবেশমুখে টাঙানো একটি নোটিশ আমাদের চোখে পড়ে। লেখা ছিল, অনিবার্য কারণে আগামী ৫ নভেম্বর থেকে এই শাখায় অনলাইন চেক পেমেন্ট সাময়িকভাবে বন্ধ থাকবে। এরপর ম্যানেজারের রুমে গিয়ে দেখি তিনি অফিসে নেই।
একজন কর্মচারী জানান, তিনি কোনো কাজে বাইরে গেছেন। শুধু ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকই নয়, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ও ন্যাশনাল ব্যাংকও গ্রাহকদের দাবি অনুযায়ী জমাকৃত টাকা ফেরত দিতে পারছে না। রেমিট্যান্স ও সেভিংস সার্টিফিকেট থেকে মুনাফার টাকা তুলতেও সমস্যায় পড়ছেন গ্রাহকরা। টাকা ফেরত দিতে না পারায় এখনও কয়েকটি ব্যাংকের শাখায় অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গ্যারান্টিতে আন্তঃব্যাংক থেকে বিশেষ ঋণ পেলেও ব্যাংকগুলোর তারল্য পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে বিকল্প পদ্ধতির মাধ্যমে সংকটে থাকা দুর্বল ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা দেওয়ার কথা ভাবছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে বিকল্প পদ্ধতি কী হবে সে বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা বলেন, তারল্য সংকটের কারণে চাপে থাকা দেশের ব্যাংকগুলোকে অন্য কোনোভাবে সহায়তা দেওয়ার সিদ্ধান্ত এখনো নেয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে এই মুহূর্তে বিষয়টি নিয়ে ব্যাংকগুলোর সঙ্গে আলোচনা চলছে। সে আলোচনার ভিত্তিতে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে তা কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিবেচনা করবে।
নানা অনিয়ম ও ঋণ জালিয়াতির কারণে গত দুই বছর ধরে দেশের প্রায় ১২টি ব্যাংক তারল্য সংকটে রয়েছে। এর মধ্যে এস আলম শেখ হাসিনার আমলে আটটি ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ করেন। তাদের অধিকাংশই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিআরআর ও এসএলআর বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। এরপরও ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি সাবেক গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার।
পরবর্তীতে, যখন এই ব্যাংকগুলি আরও তারল্য সংকটের সম্মুখীন হয়, তখন তাদের চলতি হিসাবের ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও লেনদেন করার অনুমতি দেওয়া হয়। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নতুন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর সব সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেন।
এর ফলে ব্যাংকগুলোর সঠিক আর্থিক চিত্র ফুটে উঠতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে এস আলমের নিয়ন্ত্রণাধীন আটটি ব্যাংকসহ মোট ১১টি ব্যাংকের বোর্ড ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এরপর এ তালিকায় থাকা বেশ কয়েকটি ব্যাংকের তারল্য সংকট আরও প্রকট হয়ে ওঠে। ফলে নতুন আমানত রাখার পরিবর্তে ব্যাংকগুলো থেকে বিদ্যমান আমানত তুলে নেওয়ার চাপ অনেকটাই বেড়েছে। গতকাল দুপুর ২টার আগে ইয়াসিন আরাফাত নামে এক গ্রাহক ৩০ হাজার টাকা তুলতে সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের দিলকুশা প্রিন্সিপাল শাখায় আসেন। কিন্তু তাকে বলা হয় ৫০ হাজার টাকার বেশি তোলা সম্ভব নয়। ইয়াসিন আরাফাত বলেন, তিনি কুমিল্লার এই ব্যাংকের মুরাদনগর শাখার গ্রাহক। ব্যাংকে তার ১২ লাখ টাকা আটকে আছে। সরকার পরিবর্তনের শুরুতে তিনি প্রতিদিন ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা তুলতে পেরেছিলেন। এখন তিনি ৫০ হাজার টাকার বেশি দিতে চান না।
এই ব্যাংকের বিপরীতে ন্যাশনাল ব্যাংকের দিলকুশা শাখা। সেখানে গিয়ে দেখি, ব্যাংকে তেমন ভিড় নেই। তবে ব্যাংকের ভেতরে থাকা ১০ থেকে ১২ জন গ্রাহকের মধ্যে আটজনই চেক নিয়ে ক্যাশ কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। এ ব্যাংকে আসা দুলাল নামের এক গ্রাহক আমাদের সময়কে বলেন, এই শাখা থেকে ১০ হাজার টাকার বেশি তোলা যাবে না। তবে এই ১০ হাজার টাকা শুধুমাত্র এই শাখার গ্রাহকরা তুলতে পারবেন। অনলাইন চেক জন্য কোন অর্থ প্রদান উপলব্ধ. তবে পরিচিত কেউ থাকলে তদবিরের মাধ্যমে তা প্রত্যাহার করা যাবে।
আওয়ামী লীগ আমলে অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে দুর্বল হয়ে পড়া ব্যাংকগুলোকে বিশেষ ব্যবস্থায় তারল্য সহায়তা দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত দেড় মাসে সাতটি দুর্বল ব্যাংককে আন্তঃব্যাংক থেকে ৭ হাজার ৫০ কোটি টাকা বিশেষ ঋণ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংক ২.৯৫০ কোটি, সামাজিক ইসলামী ব্যাংক ১.১৭৫ কোটি, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ১.০০০ কোটি, ইউনিয়ন ব্যাংক ৪০০ কোটি, গ্লোবাল ইসলামী ২৯৫ কোটি, ন্যাশনাল ব্যাংক ৯২০ কোটি এবং এক্সিম ব্যাংক ৭০০ কোটি টাকা তারল্য পায়। যদিও তা ব্যাংকগুলোর চাহিদার তুলনায় কম।
Follow: greenbanglaonline24