জাতীয়

বিদ্যুৎ সংকটের নেপথ্য  ভুল নীতি, অব্যবস্থাপনা

নজিরবিহীন তাপপ্রবাহ বিদ্যুতের চাহিদা অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে। বিদ্যুতের চাহিদা এখন ১৬ হাজার মেগাওয়াট। তবে প্রকৃত চাহিদা এর চেয়ে বেশি। বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৩ হাজার ৩৭০ মেগাওয়াট। অর্থাৎ চাহিদার তুলনায় উৎপাদন ক্ষমতা ৩২ শতাংশ বেশি। তবে দেশজুড়ে কেন ভয়াবহ লোডশেডিং হচ্ছে সেই প্রশ্ন এখন দেশ-বিদেশে।

গ্রামে ১০-১২ ঘন্টা বিদ্যুৎ নেই। ঘাটতি তিন হাজার মেগাওয়াটের বেশি। বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, ডলার সংকটের কারণে জ্বালানি (তেল, গ্যাস ও কয়লা) আমদানি ব্যাহত হওয়ায় চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। গ্যাস, কয়লা ও চুল্লি আমদানি এবং বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল বাবদ বর্তমানে ৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার বা ৪০ হাজার কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে।

ডলার সংকট ছাড়াও বর্তমান সংকটের জন্য বিশেষজ্ঞরা অসঙ্গতি, অব্যবস্থাপনা ও ভুল নীতিকে দায়ী করছেন। তারা বলছেন, সময়মতো ডলার ছাড় না করায় বর্তমান জ্বালানি সংকট হয়েছে। এখন ডলারের চাপে ছাড় দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সময়মতো বিল পরিশোধ করলে কয়লা বা অন্য জ্বালানি সংকট হতো না। চাহিদার অনুপাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হবে। এ ছাড়া অতিরিক্ত বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন, দেশীয় উৎসের পরিবর্তে আমদানি করা জ্বালানি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের মতো উদ্যোগ এ খাতের ব্যয় অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। এখন ঘন ঘন মূল্যবৃদ্ধি ও ভর্তুকি দিয়ে চাপ সামলানো কঠিন হয়ে পড়েছে।

সংশ্লিষ্টদের মতে, সময়মতো বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ ও নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা না গেলে এ সমস্যার আশু সমাধান হবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ খাত সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে ধরে রাখার চাপ রয়েছে। এদিকে প্রতিদিনের খাদ্যপণ্য আমদানিতে ডলার ছাড়ের দাবি রয়েছে। ফলে বর্তমানে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের চাহিদা অনুযায়ী সঠিক সময়ে পরিমাণ অনুযায়ী ডলার ছাড় দেওয়া খুবই কঠিন।

পিডিবি কর্মকর্তাদের মতে, লোড ব্যবস্থাপনার বৈষম্য কমিয়ে দুর্ভোগ কিছুটা কমানো যেতে পারে। এর বাইরে আবহাওয়া অনুকূলে থাকা ছাড়া উপায় নেই। বৃষ্টি হলে বিদ্যুতের চাহিদা কমে যাবে। তাহলে কষ্ট কমানো যাবে।

বিদ্যুৎ সক্ষমতা কাজ করছে না

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্য অনুযায়ী, বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা এখন ২৩ হাজার ৩৭০ মেগাওয়াট। গত মঙ্গলবার জ্বালানির অভাবে ৫০৩৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়নি। এ ছাড়া নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের জন্য বন্ধ ছিল ২ হাজার ৯৭৭ মেগাওয়াট। তখনও পিডিবির উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ১৫,৩৩৩ মেগাওয়াট। রাত ৯টায় দিনের সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ১৫ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। অর্থাৎ ৫০০ মেগাওয়াটের বেশি লোডশেডিং হওয়া চলবে না। কিন্তু ওই দিন ৩০৯৩ মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেড করতে হয়েছে।

এর কারণ হলো সব বিদ্যুৎকেন্দ্র সব সময় চালু করা যায় না। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মধ্যে রয়েছে ৪৫৯ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ, যা সন্ধ্যার পর আর উৎপাদনে থাকে না। মঙ্গলবার সোলার থেকে সর্বোচ্চ ৩৯৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া গেছে।

৩১ শতাংশ বিদ্যুৎ কেন্দ্র ফার্নেস অয়েল ও ডিজেলে চলে। ধারণক্ষমতা ৭ হাজার ১১৯ মেগাওয়াট। উচ্চ খরচ, পাওয়ার প্ল্যান্টের ধরন (পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্ট) কারণে, এই তেল ভিত্তিক প্ল্যান্টগুলি দক্ষতা বজায় রাখতে সন্ধ্যা ৭ টা থেকে রাত ১১ টা পর্যন্ত বেশি চলে। গ্রীষ্মে বর্ধিত চাহিদা সামলানোর জন্য তেল স্টেশনগুলি উচ্চ হারে চলে, যার ফলে সরঞ্জামগুলি ছিঁড়ে যায়। তাই তাদের প্রায় বিশ্রামে রাখা হয়।

গত মঙ্গলবারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত তেলভিত্তিক প্ল্যান্ট থেকে ৪,২০০ মেগাওয়াট থেকে ৪,৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। অন্য সময়ে এই কেন্দ্রগুলি ১৬০০ থেকে ২৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। এ ছাড়া তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর বেশির ভাগই ব্যক্তি মালিকানাধীন। বেসরকারি উদ্যোক্তাদের কাছে সরকার প্রায় ২০০ মিলিয়ন বিল পাওনা। ফলে তারা চাইলেও ফার্নেস অয়েল আনতে পারছে না। এ কারণে উৎপাদন কমে যাচ্ছে।

কয়লা ও গ্যাসভিত্তিক প্ল্যান্ট সারাদিন চলতে পারে। দেশের গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা ১১ হাজার মেগাওয়াট। গত মঙ্গলবার সর্বোচ্চ উৎপাদন হয়েছে ৬ হাজার ১৬৫ মেগাওয়াট। ওইদিন ১২০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়। পূর্ণ ক্ষমতার জন্য ২২০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস প্রয়োজন। পেট্রোবাংলা বলছে, বর্তমানে যে গ্যাস দেওয়া হচ্ছে তার বেশি দেওয়া সম্ভব নয়। পেট্রোবাংলা জানিয়েছে, গ্যাস বিল বকেয়া আছে ৪৮৮.৮ মিলিয়ন। এর মধ্যে শেভরনের পাওনা রয়েছে ২২০ মিলিয়ন, দীর্ঘমেয়াদী এলএনজি চুক্তির জন্য ১৪২ মিলিয়ন, স্পট এলএনজির জন্য ১১.৫ মিলিয়ন এবং এলএনজি টার্মিনালগুলির জন্য ১.১ মিলিয়ন।

কয়লাভিত্তিক প্ল্যান্টের উৎপাদন ক্ষমতা ৩ হাজার ৩৬০ মেগাওয়াট। কয়লার ঘাটতির কারণে মঙ্গলবার উৎপাদন হয়েছে ১৬০০ থেকে ২০০ মেগাওয়াট। কয়লা সংকটের কারণে পেয়ারা বন্ধ রয়েছে। রামপাল তার ধারণক্ষমতার অর্ধেক উৎপাদন করছে। পায়রা কয়লা আসতে আরো তিন সপ্তাহ লাগবে। কয়লা বিলের জন্য পায়রা ৩০০ মিলিয়ন পাওনা।