আদানির বিদ্যুতের কী হবে?
ভারতের আদানি গ্রুপ থেকে ১৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কিনতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আগামী মার্চ থেকে ৭৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি শুরু হতে পারে। চলমান বিদ্যুৎ সংকট উত্তরণে সরকার এই ক্ষমতার ওপর অনেকটাই নির্ভর করছে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের রিপোর্টের পর গত কয়েকদিনে আদানির বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারের দাম ধস নেমেছে। তাদের আর্থিক দুরবস্থা বাংলাদেশে বিদ্যুৎ রপ্তানিতে প্রভাব ফেলবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
হিন্ডেনবার্গের প্রতিবেদনে আদানির ব্যবসা সম্প্রসারণের বিভিন্ন অনিয়ম তুলে ধরা হয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের সঙ্গে আদানির চুক্তি নিয়ে চলছে নানা সমালোচনা। সূত্র জানায়, চুক্তির সীমাবদ্ধতার কারণে ভারতের ঝাড়খণ্ডের গোড্ডায় নির্মিত বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত কয়লার দাম বেশি হবে, যা বাংলাদেশকে দিতে হবে। এ ছাড়া ভারতের উচ্চ কর্পোরেট ট্যাক্স, কয়লার উচ্চ পরিবহন খরচের কারণে এই বিদ্যুতের দাম দেশের অন্যান্য কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে বেশি হবে। আদানির বিদ্যুতের দাম ভারত থেকে আমদানি করা অন্যান্য বিদ্যুতের দামের তিনগুণ এবং পায়রা প্ল্যান্টের দামের দ্বিগুণ হবে।
ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে আদানিকে দিতে হচ্ছে বিশাল অঙ্ক। উল্টো চুক্তি অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশও ক্ষতিপূরণ পাবে। তবে ক্ষতিপূরণের বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে বিস্তারিত জানা যায়নি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আদানির ব্যবসায় বড় ধরনের ধস নামলে জ্বালানি কেনার সংকট পড়তে পারে। এমনটা হলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সমস্যা হতে পারে। এ ছাড়া বাংলাদেশের আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কা নেই। তবে আদানি বিদ্যুৎ না পেলে গ্রীষ্ম ও সেচ মৌসুমে বাড়তি চাহিদা সামলানো সরকারের পক্ষে কঠিন হবে বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
জানতে চাইলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, প্রথমে ড. পরিচ্ছন্ন শক্তির ক্ষেত্রে আদানির শক্তি পরিবেশের জন্য ভাল নয়। দ্বিতীয়ত। চুক্তিতে নানা অসঙ্গতির কারণে এ বিদ্যুতের দাম তুলনামূলক বেশি। ফলে আদানির সঙ্গে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তিতে দেশের স্বার্থ রক্ষা হয়নি। এখন আর্থিক দিক থেকে বলতে গেলে আমাদের দেখতে হবে বাংলাদেশ যে কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনছে তা শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কিনা। কারণ, আদানির লোকসান হয়েছে মূলত কোম্পানির শেয়ারের দাম পড়ে যাওয়ায়। তাই আদানির জ্বালানি ক্রয় ব্যাহত না হলে আমাদের খুব একটা প্রভাব ফেলবে না।
জানতে চাইলে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, আদানির শেয়ারের দাম কমেছে। এর সঙ্গে বিদ্যুৎ বিক্রির কোনো সম্পর্ক নেই। তাদের শেয়ারের দাম বাড়তে বা কমতে পারে। এতে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হবে না।
বাংলাদেশে রপ্তানির জন্য বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ করেছে আদানি গ্রুপ। সেখান থেকে বাংলাদেশ সীমান্ত পর্যন্ত প্রায় ১০৬ কিলোমিটার এবং বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে জাতীয় গ্রিডে আরও ৩০ কিলোমিটার চালু করা হয়েছে। আদানি ১০ ডিসেম্বর থেকে পরীক্ষামূলকভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করছে। এখন ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসছে। এই কেন্দ্র থেকে ১ হাজার ৩৪৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে।
আদানি ও বাংলাদেশের মধ্যে হওয়া চুক্তি বিশ্লেষণ করে ওয়াশিংটন পোস্টের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অন্যান্য কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দাম যত বেশিই হোক না কেন বাংলাদেশ একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ছাড় পায়। কিন্তু আদানির সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী আন্তর্জাতিক হার অনুযায়ী কয়লার দাম দেবে বাংলাদেশ। এতে জ্বালানি খরচ হবে বেশি।
ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিক্স অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিস (আইইইএফএ) এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুসারে, আদানি ভারতে যে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি পরিচালনা করে তার বেশিরভাগই সমুদ্রের কাছে; যাতে সড়ক বা রেলপথে কয়লা পরিবহনের খরচ কমানো যায়। কিন্তু গোড্ডা বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বন্দর থেকে অনেক দূরে হওয়ায় কয়লা পরিবহনে বাড়তি খরচ বাড়বে বিদ্যুতের দাম। আদানির ব্যবসা হলেও তা বাংলাদেশের জন্য বাড়তি বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।
সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশকে আদানির বিদ্যুৎ কিনতে হবে প্রতি ইউনিট ১৬-১৭ টাকায়। তবে আমদানি করা কয়লা দিয়ে উৎপাদিত পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পড়ছে ৮ থেকে ৯ টাকা। পাওয়ার সেলের রিপোর্ট অনুযায়ী আদানির ক্ষমতার চার্জ অন্যান্য বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তুলনায় বেশি। আদানিকে ২৫ বছরের চুক্তিতে ক্ষমতা চার্জ হিসাবে ৯৬,২০০ কোটি টাকা দিতে হবে।