জাতীয়

পদ্মার গতিপথই পাল্টে দিয়েছে বালুখেকোরা ।ঈশ্বরদী পাকশী

ঈশ্বরদীর পাকশীতে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচের গেজ দিয়ে পদ্মা নদীর পানির গভীরতা নির্ণয় করা হয়। প্রবল বৃষ্টিতেও রেল সেতুর প্রথম পিলারে পানি আসে না। শুষ্ক মৌসুমে নদীটি আরও দূরে প্রবাহিত হয়।

পদ্মায় পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় এর জন্য স্থানীয় বালু ব্যবসায়ীরাও কম দায়ী নয়।

রেলওয়ে ব্রিজের পাশে নদীতে ৭০ বিঘা জমিতে বালু মজুত এলাকা গড়ে তুলেছেন তারা। ব্যবসায়ীরা নদীর বিভিন্ন স্থান থেকে বালু এনে এখানে স্তূপ করে। এ স্থান থেকে ট্রাক, ট্রাক্টর ও ড্রামে করে দেশের বিভিন্ন স্থানে বালু পাঠানো হয়। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে বালির স্তূপের কারণে হার্ডিঞ্জ সেতু ও লালন শাহ সেতু সংলগ্ন প্রথম পিলারে আর পানি পৌঁছায় না। পদ্মার পানি প্রবাহ অন্তত ৩০০ মিটার সরে গেছে।

নদী গবেষকরা বলছেন, এখনই উদ্যোগ না নিলে নদীর ওপারে তীব্র ভাঙন দেখা দিতে পারে। নদীর গতিপথ পরিবর্তন হলে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও লালন শাহ সেতুসহ পুরো এলাকার পরিবেশ হুমকির মুখে পড়বে।

সেতুর পাশের পরিবেশ ধ্বংসকারী এই কর্মকাণ্ডের দায় সরকার এড়াতে পারে না। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ নিজেই নদীতে জায়গাটি বালু ব্যবসায়ীদের ইজারা দিয়েছে। কৃষি জমি হিসেবে ইজারা দিলেও দীর্ঘদিন ধরে সেখানে বালির ব্যবসা হচ্ছে। তবে রেলওয়ে এখন পর্যন্ত সেগুলো অপসারণের কোনো উদ্যোগ নেয়নি।

সরেজমিনে দেখা যায়, সেতু দুটি এলাকায় ব্রিজের পাশে চারণভূমিতে বিস্তীর্ণ এলাকায় শুধু বড় বড় বালির স্তূপ রয়েছে। সেখান থেকে ট্রাকে করে বালু তোলা হচ্ছে। ট্রলারে আনা বালু নামিয়ে নতুন স্তূপ তৈরি করা হচ্ছে। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে এক সময়ের প্রবল পদ্মা।

স্থানীয়রা জানান, বালুর ব্যবসার সঙ্গে শাসক দলের একাধিক নেতা জড়িত। এখান থেকে প্রতিদিন অন্তত ৮০০ ট্রাক বালু বিক্রি হয়। টাকার দিক থেকে দিনে প্রায় ১০ লাখ টাকার ব্যবসা হয়। এখানকার বালু ব্যবসার সমন্বয়ক হলেও পাকশী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও সাবেক চেয়ারম্যান এনামুল হক বিশ্বাসের দাবি, দিনে ৩শ থেকে ৫শ ট্রাক বালু বিক্রি হয়। হার্ডিঞ্জ ব্রিজের কাছে বালির স্তূপ থাকলেও এখান থেকে তোলা হয় না বলেও দাবি করেন তিনি। কুষ্টিয়া, আলাইপুর, পাবনাসহ বিভিন্ন ঘাট থেকে নৌকায় করে এই বালু এখানে আনা হয়। পরে ট্রাকে করে বালু বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয়। এ কারণে সেতুটি যেন বিপদে না পড়ে।

এদিকে এসব ট্রাক থেকে দৈনিক ১শ’ টাকা চাঁদা আদায় করা হয়। সেই টাকা চলে যায় স্থানীয় নেতা থেকে শুরু করে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বিভিন্ন অংশে। এনামুল হকও বিষয়টি স্বীকার করেছেন। সরেজমিনে দেখা যায়, নিয়মিত বিরতিতে বালুমহালে ট্রাক ও ট্রাক্টর আসছে। কেউ কেউ বালু বহনের সময় তাদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।

বালুঘাটের একজন ব্যবস্থাপক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এখানে ১০-১২ জন বালু ব্যবসায়ী রয়েছে। তারা বিভিন্ন স্থানে বালু মজুদ করে রেখেছে। সবাই ম্যানেজার নিয়োগ করে বালু বিক্রি করছে।

স্থানীয়রা জানান, বালু ব্যবসার সঙ্গে জড়িতরা সবাই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মী। পদ্মার বিশাল এলাকা ইজারা না নিয়ে ভাড়াটিয়া কৃষকদের কাছ থেকে খাজনা নিয়ে বালু ব্যবসা করছে তারা। যদিও পাকশী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি হাবিবুল ইসলামের দাবি, আওয়ামী লীগের উল্লেখযোগ্য কোনো নেতা এই বালু ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত নন। এটি স্থানীয় ব্যবসায়ীদের দ্বারা পরিচালিত হয়।

পাকশী ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন জানান, কয়েক বছর আগে বালু ব্যবসা পরিচালনার জন্য দলের কয়েকজন নেতার মধ্যে সমন্বয় ছিল। কিন্তু এখন বালুমহাল ও বালুর ঘাট ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে। তারা কাউকে পাত্তা দেয় না।

নদী গবেষক হেরিটেজ রাজশাহীর সভাপতি মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, নদীর স্থলে নদী না থাকলে পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। নদীতে পানি প্রবেশ করার সময় এটি এক দফা ক্ষতির কারণ এবং এটি নামার সময় আরেকটি দফা ক্ষতি করে।

নদী গবেষক পাকশীর সিনিয়র অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ বলেন, পাহাড়ি বালুর স্তূপে পদ্মার পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে এখন নদীর মাঝখানে সীমাবদ্ধ। এতে নদীপাড়ের মানুষও কৃষিকাজের জন্য প্রয়োজনীয় পানি পান না।

বড়াল রক্ষা আন্দোলনের সদস্য সচিব এসএম মিজানুর রহমান বলেন, নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হলে নদীর অপর পাড় ভাঙনের মুখে পড়বে। নদীর ওপর নির্মিত সেতুগুলোও হুমকির মুখে পড়তে পারে। আইনি অপব্যবহার বন্ধ না হলে নদীর অবস্থা আরও খারাপ হবে।

মন্তব্য করুন