জাপায় ‘সরকারের মধ্যস্থতা’
জাতীয় পার্টির (জাপা) ভাঙন ঠেকাতে ‘মধ্যস্থতা’ করছে সরকার। জাপা চেয়ারম্যান জিএম কাদেরকে নেতৃত্ব থেকে অপসারণে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের ডাকা কাউন্সিল স্থগিত করা হয়েছে। সংসদ বর্জনের ঘোষণার ১৬ ঘণ্টা পর সোমবার অধিবেশনে যোগ দেন জিএমের এমপিরা।
এ তথ্য দিয়ে জাপা সূত্র জানায়, জিএম কাদের ও রওশন এরশাদের মধ্যে বিরোধ নিষ্পত্তিতে দুই পক্ষের মধ্যে সরাসরি কোনো আলোচনা হয়নি। দুই পক্ষই সরকারের নির্দেশে চলছে। তবে নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় রওশন এরশাদকে বিরোধীদলীয় নেতা পদে বসানোর ব্যাপারে জিএম কাদেরের পীড়াপীড়ির কারণে সরকারের হস্তক্ষেপ কতটা টেকসই হবে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
এ সূত্র জানায়, সরকার রওশন এরশাদকে বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে চায়। কিন্তু তিনি পূর্ণ সমর্থন দিচ্ছেন না। রওশন এরশাদ সমর্থকরা সরকারের সমর্থন নিয়ে কাউন্সিল করতে পারলে জাপার ধ্বংস নিশ্চিত। তৃণমূলের নেতাকর্মীসহ দলের একটি বড় অংশ জিএম কাদেরের পক্ষে। সরকারপন্থী বন্ধনীতে আরেকটি জাপা গঠন হলে জিএম কাদের নেতৃত্বাধীন উপদল বিএনপির দিকে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ কারণে উভয় পক্ষকেই নিয়ন্ত্রণে রাখছে সরকার।
যদিও এ নিয়ে কোনো নেতাই প্রকাশ্যে মুখ খোলেননি। রওশন ও জিএম কাদেরপন্থী একাধিক নেতা বলেন, শুধু বিরোধী দলীয় নেতার পদ নিয়ে টানাপোড়েন নয়; দেবর-ভাবীর সমঝোতার পথে আরও অনেক বাধা রয়েছে।
রওশন এরশাদকে সমর্থন দিয়ে দলীয় পদ হারান মসিউর রহমান রাঙ্গা। তাকে বিরোধী দলের চিফ হুইপের পদ থেকে অব্যাহতি দিতে স্পিকারের কাছে চিঠি দিয়েছেন জিএম কাদের। যারা দলীয় পদ হারিয়েছেন এবং রাঙ্গাসহ রওশনের পক্ষ থেকে বাদ পড়েছেন তাদের কীভাবে পুনর্বাসন করা হবে সেটাও বড় সমস্যা। এসব নেতাকে ফিরিয়ে নিতে রাজি নন জিএম কাদের।
দলের প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জীবনকাল থেকেই জিএম কাদের ও রওশন এরশাদের মধ্যে বিরোধ চলে আসছে। ২০১৯ সালের জুলাইয়ে এরশাদের মৃত্যুর পর বিরোধী দল
নেতা পদ নিয়ে দেওয়ার ও ভাবীর বিরোধের জেরে দল ভেঙে পড়ে। নেতাদের মধ্যস্থতায় জিএম কাদেরকে পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে মেনে নেন রওশন এরশাদ। জিএম কাদেরও রওশনকে বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে মেনে নেন। ওই বছরের কাউন্সিলে রওশনকে ক্ষমতাহীন প্রধান পৃষ্ঠপোষকের পদ দেন জিএম কাদের।
তিন বছর ধরে চলা স্থিতাবস্থা ভেঙে গেছে দুই মাস আগে। থাইল্যান্ডে চিকিৎসাধীন রওশন এরশাদ গত ৩১ আগস্ট নিজেকে সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক ঘোষণা করে দলের ‘কাউন্সিল’ হিসেবে একটি চিঠি দেন। চিঠিটি বেআইনি উল্লেখ করে প্রত্যাহারের আল্টিমেটাম দেওয়া হয়। রওশন রাজি না হওয়ায় তাকে সরিয়ে পরের দিন জিএম কাদেরকে বিরোধী দলীয় নেতা নির্বাচিত করা হয়। শিরীন শারমিনকে চিঠি দিয়েছে জাপা সংসদীয় দল।
দলের ২৬ জন সংসদ সদস্যের মধ্যে ২৪ জনের সমর্থন থাকলেও দুই মাস পেরিয়ে গেলেও জিএম কাদেরকে স্পিকার বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দেননি। তিনি বলেন, বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। গত রোববার সন্ধ্যায় জাপা সাধারণ সম্পাদকসহ কয়েকজন সংসদ সদস্য স্পিকারের সঙ্গে দেখা করেন। সেখানে স্পিকার তাদের আভাস দেন- সরকার বিরোধীদলীয় নেতার অবস্থান পরিবর্তন করতে চায় না।
ওইদিনের অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বক্তব্যে ‘মনে করিয়ে দেন’- ১৯৯১ সালের পর এরশাদ, রওশনসহ জাপা নেতাদের ওপর বিএনপি সরকার কী ধরনের নির্যাতন করেছে।সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে জাপা নেতারা আশ্বস্ত হয়েছিলেন এবং স্পিকারের কথায়- সরকার জিএম কাদেরকে বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে চায় না। তাই বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে স্বীকৃতি না পাওয়া পর্যন্ত জিএম কাদের সংসদে যাবেন না বলে ঘোষণা দেন। এই ‘কঠোর’ সিদ্ধান্তের আধঘণ্টা পরে ঘোষণা আসে – রোশান ২৬ নভেম্বরের কাউন্সিল স্থগিত করেন। তবে জাপা নেতারা এর আগে কয়েকবার চেষ্টা করেও রওশনকে কাউন্সিল স্থগিত করতে রাজি করতে পারেননি। জিএম কাদেরের দাবি ছিল রওশনকে কাউন্সিল স্থগিত করে দলের নেতৃত্ব মেনে নিতে হবে।
কাউন্সিলের প্রস্তুতির সঙ্গে জড়িত রওশনের ঘনিষ্ঠ এক নেতা বলেন, সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশনায় রওশন এরশাদ বরখাস্তের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সংসদ বর্জন এবং পরিষদ স্থগিত করার মধ্যে সংযোগ থাকতে পারে। এদিকে জাপা চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠ এক প্রেসিডিয়াম সদস্য সূত্রে জানা গেছে, সরকারের উচ্চপর্যায়ের সঙ্গে কথা বলে সোমবার বিকেলে সংসদে ফেরার ঘোষণা দেন জিএম কাদের।
তবে রওশনের ঘোষিত সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির সদস্য সচিব গোলাম মসীহ বলেন, পুরো ঘটনাটাই কাকতালীয়। সরকারের কারো সঙ্গে কোনো আলোচনা বা সমঝোতা হয়নি। প্রস্তুতির অভাবে কাউন্সিল স্থগিত করা হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। সব জেলা ও উপজেলায় কমিটি নিয়ে কাউন্সিল হবে। দুই থেকে তিন মাস সময় লাগতে পারে।