জাতীয়

সোয়া লাখ টাকা দিলেই রোহিঙ্গাদের এনআইডি মিলে

একদল রোহিঙ্গাকে সংগ্রহ করে চট্টগ্রাম শহরে নিয়ে আসা হয়। এই শহরের ঠিকানা ব্যবহার করে সিটি কর্পোরেশন থেকে তাদের জন্ম সনদ সাজানো হয়েছে। পরে তা জাতীয় পরিচয়পত্র (NID) দিয়ে করা হয়। বিনিময়ে দালালরা পান জনপ্রতি সোয়া লাখ টাকারও বেশি।

নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ের ডাটা এন্ট্রি অপারেটর, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) কর্মী ও কক্সবাজারের কয়েকজন দালাল এই চক্রের সঙ্গে জড়িত। নির্বাচন কমিশনের চলমান ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রমের আওতায় বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির এই চক্রের সন্ধান পেয়েছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)।

তাদের অভিযানে ইসির পাঁচ ডাটা এন্ট্রি অপারেটর, দুই রোহিঙ্গা ও ১০ জনকে আটক করা হয়। বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হয়।

গ্রেপ্তার হওয়া পাঁচ ডাটা এন্ট্রি অপারেটর হলেন ইয়াছিন আরাফাত, নূরনবী, মিজানুর রহমান, ফরহাদুল ইসলাম ও ইমন দাস। বাকি পাঁচজন হলেন নুরুল আবছার, শামসুর রহমান, মো. কামাল এবং রোহিঙ্গা শরণার্থী কামাল হোসেন ও পারভীন আখতার।

এদের মধ্যে শামসুর রহমান কক্সবাজারের পোকখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক। তার বিরুদ্ধে এনআইডি জালিয়াতি সংক্রান্ত কক্সবাজার ও এসডিসিতে তিনটি মামলা রয়েছে। এ কারণে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। শামসুর রহমান ও নুরুল আবছার প্রতারণার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের এনআইডি করেন। কামাল হোসেন কক্সবাজারের একটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে থাকেন। পারভীন একজন বাংলাদেশীকে বিয়ে করে কক্সবাজারের ঈদগাহ এলাকায় থাকেন। তাদের বিরুদ্ধে হালিশহর থানায় পৃথক দুটি মামলা হয়েছে।

গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত মঙ্গলবার নগরীর হালিশহর আবাসিক এলাকার বি-ব্লকের হালিশহর হাউজিং এস্টেট উচ্চ বিদ্যালয়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদ ও জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির কার্যক্রম চলছিল। কক্সবাজার থেকে মিয়ানমারের দুই রোহিঙ্গা নাগরিক ভোটার হতে এসেছেন বলে গোপন সূত্রে খবর পায় গোয়েন্দা পুলিশ। পরে রোহিঙ্গা নাগরিক কামাল ও পারভীনকে আটক করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানান, শামসুর রহমান ও নুরুল আবছার তাদের ভোটার বানানোর জন্য হালিশহরে নিয়ে আসেন। পরে নগরীর বহদ্দারহাট এলাকা থেকে দুইজনকে আটক করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদ ও মোবাইল ফোনের তথ্য যাচাই-বাছাই করে পাঁচ ডাটা এন্ট্রি অপারেটরকে গ্রেপ্তার করা হয়। কামাল নামে এক সিএনজি অটোরিকশা চালক তাদের হালিশহরে নিয়ে যান। তাকেও গ্রেফতার করা হয়।

নগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি-বন্দর) উপ-কমিশনার মুহাম্মদ আলী হোসেন বলেন, শামসুর ও আবছার রোহিঙ্গাদের বিশ্বস্ত দালাল। তারা ক্যাম্পে গিয়ে রোহিঙ্গাদের সংগ্রহ করে। এনআইডি তৈরিতে কক্সবাজারে বেশি যাচাই-বাছাই করায় তারা তাদের চট্টগ্রামে নিয়ে আসে। তিনি প্রত্যেকের কাছ থেকে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা নেন। ডিএনসিসির এক কর্মকর্তার মোবাইলে নাম-ঠিকানা পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে আধা ঘণ্টার মধ্যে মোবাইলে জন্ম সনদ চলে আসে। ব্যবহৃত ঠিকানা চট্টগ্রাম। ডাটা এন্ট্রি অপারেটরের মাধ্যমে ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রমের বিভিন্ন কেন্দ্রে লাইনে দাঁড়িয়ে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এনআইডি পাচ্ছেন তারা। বিনিময়ে অপারেটররা পায় ৯ হাজার টাকা। আবছার মোবাইল ফোনে অন্তত ৫০০ রোহিঙ্গার জন্ম সনদের ছবি পাওয়া গেছে।

নগর গোয়েন্দা পুলিশের (বন্দর) অতিরিক্ত উপ-কমিশনার শামীম কবির বলেন, জালিয়াতির সঙ্গে ইসির চলমান প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত আউটসোর্স কর্মচারীদের জড়িত থাকার তথ্য পেয়েছে এনআইডি। তাদের সঙ্গে ঢাকায় নির্বাচন কমিশন অফিসে কর্মরত কয়েকজনের নামও পাওয়া গেছে যারা তথ্য সার্ভারে প্রবেশ করেছে। ডিএনসিসির একজন ও নির্বাচন কমিশনের একজন কর্মকর্তার নামও পাওয়া গেছে। তারা এসব বিষয় খতিয়ে দেখছেন। রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে একটি নির্বাচন কমিশন নিবন্ধন ফরম পাওয়া গেছে। সাধারণত, এই ফর্ম নির্বাচন অফিসার ছাড়া অন্য কারো কাছ থেকে নেওয়া হয় না।

এ বিষয়ে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মোহাম্মদ হাসানুজ্জামান বলেন, আউটসোর্সিংয়ের সঙ্গে তাদের অফিসের কেউ জড়িত আছে কিনা তাও খতিয়ে দেখছেন। তদন্তে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি দাবি করেন, নির্বাচন কমিশন রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে যে নিবন্ধন ফরম পেয়েছে সেটি চট্টগ্রামের সিরিয়ালের নয়।

মন্তব্য করুন