প্রতি মাসে ৩০ কোটি টাকার ব্যবসা অবৈধ রিকশায়
ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা নিয়ে চলছে নৈরাজ্য। নিয়ম না মানার কারণে এই যানটিকে ঘিরে চলছে অবৈধ বাণিজ্য। রাস্তায় রিকশা নিয়ে যেতে চাইলে টাকার বিনিময়ে টোকেন নিতে হয়। টোকেন পেলেও মসৃণ চলাচলের কোনো সুযোগ নেই। প্রধান সড়ক ছাড়াও প্রচারণার নামে অটোরিকশা আটক করে মোটা অংকের বিল আদায় করা হয়। রেকার বিল রিকশা প্রতি ১ হাজার ২০০ টাকা। যদি একটি রিকশা একটি ডাম্পিং স্টেশনে নিয়ে যাওয়া হয়, আপনাকে ২০০০-৪০০০ টাকা পর্যন্ত দিতে হবে এবং রাস্তায় ফেলে দিতে হবে। রাজধানীতে অটোরিকশার এই মধুচক্রে পুলিশ ছাড়াও স্থানীয় অসাধু রাজনৈতিক নেতা ও পরমহল্লার মাস্তানরা জড়িত।
২০১৪ সালে হাইকোর্ট ঢাকা ও চট্টগ্রামে ব্যাটারিচালিত রিকশা নিষিদ্ধ করার নির্দেশ দেন। পরে ২০১৭ সালে, এই পরিবহনগুলি বন্ধ করার জন্য আরও একটি দফা নির্দেশনা আসে। ১৫ ডিসেম্বর, ২০২১-এ, সুপ্রিম কোর্ট অটো-রিকশা আমদানি নিষিদ্ধ করেছিল। বিভিন্ন সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সিটি করপোরেশন অভিযান চালালেও তা ছিল ‘বিড়াল-ইঁদুর’ খেলার মতো। গত শুক্রবার রাজধানীর মিরপুরে অন্তত সাতটি ট্রাফিক পুলিশ বক্সে হামলা ও ভাংচুর করেছে রিকশাচালকরা। হামলাকারীদের নির্মম মারধরে এক পুলিশ কনস্টেবল গুরুতর আহত হয়েছেন। এতে পুলিশের আরও পাঁচ সদস্য আহত হয়েছেন। পুলিশের ওপর রিকশাচালকদের হামলার মতো নজিরবিহীন এ ঘটনার পর আবারো আলোচনায় আসে এ খাতের গভীর সমস্যার কথা। ঢাকার বিভিন্ন এলাকার চালকরা বলছেন, নিয়মিত ভাড়া দেওয়া হলেও অভিযানের নামে প্রায়ই হয়রানি করা হয়।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকায় অন্তত দুই লাখ ব্যাটারিচালিত রিকশা রয়েছে। প্রতি রিকশায় গড়ে ১৫০০ টাকা টোকেন লেনদেন হয়। সে হিসেবে প্রতি মাসে অবৈধভাবে আদায় হয় ৩০ কোটি টাকা।
রিকশা, ব্যাটারি রিকশা-ভ্যান ও ইজিবাইক সংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক খালেকুজ্জামান লিপন বলেন, হাইকোর্ট মহাসড়কে শুধু এ ধরনের যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দিলেও পুলিশ বিভিন্ন এলাকা থেকে অটোরিকশা চালকদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে। বিভিন্ন ব্যক্তি বা সমিতির নামে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। সেই টাকার ভাগ পাচ্ছে পুলিশ। এ ছাড়া রেকার-ডাম্পিংয়ের মতো ঘটনাও ঘটছে।
তিনি বলেন, আদালত এক আদেশে উল্লেখ করেছেন, সারাদেশে ৪০লাখ ইজিবাইক ও অটোরিকশা চলাচল করে। আমরা মনে করি, বাস্তবে এই সংখ্যা এখন অর্ধ কোটি ছুঁয়েছে। এর মধ্যে শুধু ঢাকা শহরেই রয়েছে দুই লাখের বেশি। বিপুল সংখ্যক মানুষ এভাবে জীবিকা নির্বাহ করছে। এই কারণে, সরকার ‘থ্রি-হুইলার এবং সমজাতীয় মোটরযান নীতি’ তৈরি করেছে। এর মাধ্যমে বর্তমানে অবৈধ যানবাহনকে বৈধ করতে যাচ্ছে সরকার। একটি হিসেব অনুযায়ী, এই গাড়িগুলি বছরে অন্তত ১ লক্ষ কোটি টাকা আয় করছে। সেই টাকা থেকে তারা সরকারকে ১৫ হাজার কোটি টাকা ভ্যাট দিচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের প্রধান ডিআইজি মুনিবুর রহমান বলেন, পুলিশের একার পক্ষে অভিযান চালিয়ে অটোরিকশা বন্ধ করা সম্ভব নয়। এত ব্যাটারি কে আনছে? কোন জায়গা থেকে এই ব্যাটারিগুলো চার্জ করা হচ্ছে। সবাই নিজ নিজ জায়গা থেকে সক্রিয় না হলে কোনো সুফল পাওয়া যাবে না।
তবে দেশের এই নাজুক বিদ্যুতের পরিস্থিতিতে এসব অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলো হিসাবহীন বিদ্যুৎ টানছে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অবৈধভাবে বিশাল টিনশেড ঘর নির্মাণ করে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়েছে।
মিরপুর-পল্লবীর চক্র: দীর্ঘদিন ধরেই পল্লবী ও মিরপুরে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ব্যবসার একটি বড় দুষ্ট চক্র জড়িত। পুলিশ, স্থানীয় মাস্তান ও অসাধু রাজনৈতিক নেতারা সিন্ডিকেটে রয়েছে। কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী এলাকার যুবক আব্দুল কুদ্দুস দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে মিরপুরে অটোরিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। বর্তমানে তিনি মিরপুর-৭ নম্বর আবাসিক এলাকায় মা ও বোনের সঙ্গে থাকেন। অটোরিকশা নিয়ে কেমন নৈরাজ্য তার বক্তব্যে স্পষ্ট। তিনি বলেন, পুলিশের ভয়ে অটোরিকশা চালকরা বেশির ভাগ সময় অলিগলিতে অবস্থান করে। প্রধান সড়কে খুব কম অটোরিকশা চলে। কিন্তু যাদের প্রতিবন্ধী কার্ড আছে তারা সব জায়গায় যেতে পারেন। অধিকাংশ রিকশাচালক রাস্তায় থাকলেও প্রায় প্রতিদিনই পুলিশের অভিযান চলছে। অবৈধ যান চলাচলের জন্য রিকশা ডাম্পিং স্টেশনে পাঠানোর হুমকি দেয়। এরপর প্রতিটি রিকশার জন্য ৫০০ থেকে ২৫০০ টাকা ঘুষ নেন। এ ছাড়া মিরপুরের স্থানীয় নেতাদের কাছ থেকে ‘কার্ড’ নিতে হয়। ওই কার্ডের জন্য মাসে আড়াই হাজার টাকা দিতে হয়। সবাই এই টাকা ভাগ করে নিয়েছে। সেই হিসেবে শুধু কার্ড পাওয়ার জন্য রাস্তায় অটোরিকশা চালালে বছরে ২৬ হাজার ৪০০ টাকা ঘুষ দিতে হয়। এরপর কোনো কারণে আবার পুলিশের হাতে ধরা পড়লে জরিমানা দিতে হয়।