শিক্ষা অফিসার নেই ২৪ জেলায়।পরিদর্শন ও মনিটরিং ছাড়াই চলছে কার্যক্রম
জেলা পর্যায়ে সরকারের শিক্ষা কার্যক্রম তদারকি, উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন, পরিদর্শন, তদারকি ও পর্যবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা প্রধান কর্মকর্তা হলেন ‘জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা’ (ডিইও)। তবে কোনও ডিইও ছাড়াই দেশের ৬৪ টি জেলার মধ্যে ২৪ টিতে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কিশোরগঞ্জ ও গোপালগঞ্জ জেলায়ও কোনও ডিইও নেই। চট্টগ্রাম এবং সিলেটের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিভাগীয় শহরগুলি ছাড়াও এখানে বেশ কয়েকটি পুরাতন এবং বড় জেলা রয়েছে।
কোনও প্রধান কর্মকর্তা না থাকায় দায়িত্বে নিম্ন স্তরের কর্মকর্তার দায়িত্ব দিয়ে এসব জেলাতে জেলা শিক্ষা অফিসের কাজ চলছে। নিম্নলিখিত সদরের পদটিও শূন্য থাকায় জেলা সদরের সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বছরের পর বছর ধরে চলছে এমন একটি পরিস্থিতি।
গণ সাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও প্রাক্তন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন যে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সরকারের সময় দেশের প্রায় অর্ধেক জেলাগুলিতে কোন শিক্ষাব্যবস্থা ছিল না এটা দুর্ভাগ্যজনক। কারণ, শিক্ষা খাতে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে মাঠ পর্যায়ে পর্যবেক্ষণ এবং তদারকি। যদি এটি করা না যায় তবে কোনও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে যে জেলাগুলির এক তৃতীয়াংশেরও বেশি বর্তমানে জেলা শিক্ষা অফিসারদের শূন্যপদ রয়েছে। ডিইওবিহীন জেলাগুলি হলেন: গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, রাজবাড়ি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, লক্ষ্মীপুর, সিলেট, হবিগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, বগুড়া, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, চট্টগ্রাম, ভোলা, কিশোরগঞ্জ, জামালপুর, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী ও বান্দরবান। ডিইওর নিয়োগ ও পদ কর্তৃপক্ষ হ’ল মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ (মাউশি)। এত জেলায় ডিইও পদে শূন্যপদ কেন রয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে মাউসির পরিচালক (মাধ্যমিক) অধ্যাপক বেলাল হোসেন বলেন, এই মুহুর্তে ডিইও পদে পদোন্নতি পাওয়ার মতো কোনও কর্মকর্তা নেই। সুতরাং এই পোস্টে কাউকে পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে না।
নিয়োগ বিধি মোতাবেক ডিইও পদে দুইভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। পদটি পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি) পরীক্ষার মাধ্যমে ২০ শতাংশ এবং সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা (এডিইও) এর মাধ্যমে ৮০ শতাংশ পদোন্নতির মাধ্যমে পূরণ করা হবে। বর্তমানে পিএসসির মাধ্যমে ২০ শতাংশ পদ পূরণ করা হয়েছে। তবে, ফিডার পরিষেবা পূরণ না করায়, বাকি ৮০ শতাংশ পদ পদোন্নতির মাধ্যমে পূরণ করা যাবে না। যারা বর্তমানে এডিইওর পদে কাজ করছেন তাদের ২০১ ২০১৬ সালে এই পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। তাদের চার বছরের ফিডার পরিষেবাটি ডিইও হওয়ার জন্য ২০২১ সালে শেষ হবে।
সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন যে মৌসি চাইলে সহজেই জেলা শিক্ষা অফিসারের শূন্য পদ পূরণ করতে পারে। তারা ইচ্ছাকৃতভাবে এই পোস্টগুলি ফাঁকা রেখছে। এই নেতা বলেন, নিয়োগ বিধি মোতাবেক সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পদ এবং জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের পদ সমান গ্রেডের। জাতীয় বেতন স্কেলের ষষ্ঠ শ্রেণিতে এগুলি প্রদান করা হয়। মাউশি জেলা শিক্ষক কর্মকর্তা হিসাবে প্রধান শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে সহজেই এই পদগুলি পূরণ করতে পারবেন। অতীতে এরকম উদাহরণ রয়েছে।
তদন্তে দেখা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে শরীয়তপুরে জেলা শিক্ষা অফিসার নেই। সহকারী জেলা শিক্ষা অফিসার নেই। উভয় পদ শূন্য থাকায় সংলগ্ন সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে ভারপ্রাপ্ত ডিইওর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। জেলা শিক্ষা অফিসের এক কর্মচারী জানান, প্রধান কর্মকর্তা না থাকায় অনেক সমস্যা রয়েছে। বর্তমানে ২০২১ শিক্ষাবর্ষের বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক ঢাকা থেকে ছাপা হচ্ছে। ডিইও তাদের পরিচালনা, সমন্বয় ও বিতরণের জন্যও দায়বদ্ধ।
অনেক জেলায় ডিইওগুলিকে তাদের প্রধান দায়িত্ব ছাড়াও অনেকগুলি অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে হয়। অনেক জায়গায় উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের (ইউসিইও) পদ শূন্য রয়েছে এবং ডিইওরা এসব পদে রয়েছেন।
কেবল ডিইও নয়, মৌসীর নয়টি আঞ্চলিক উপ-পরিচালকদের মধ্যে তিনটি বর্তমানে শূন্য রয়েছে। চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের প্রধান শিক্ষক দেবব্রত দাস চট্টগ্রাম আঞ্চলিক উপ-পরিচালক ও জেলা শিক্ষা অফিসারের দুটি পদে অতিরিক্ত পদে রয়েছেন। সব মিলিয়ে তার এখন তিনটি দায়িত্ব। বরিশাল জেলা শিক্ষা অফিসার আনোয়ার হোসেনও মাউশির বরিশাল আঞ্চলিক উপ-পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন। কুমিল্লা সরকারী নবাব ফয়জুন্নেছা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা রোকসানা ফেরদৌসকে কুমিল্লায় আঞ্চলিক উপ-পরিচালক অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
আঞ্চলিক উপ-পরিচালকের অধীনে এলাকার বেসরকারী বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মীদের এমপিওভুক্তি সম্পন্ন করা হয়।
এমপিওভুক্তির কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে সেগুলো আঞ্চলিক অফিসে পাঠান ডিইও। এসব পদে দীর্ঘদিন ধরে ভারপ্রাপ্ত কেউ না থাকায় শিক্ষক-কর্মচারীদের ভোগান্তি আরও বেড়েছে।
নিয়মিত কর্মকর্তা না থাকায় শিক্ষার মান ও অফিস ব্যবস্থাপনায়ও ধস নেমেছে। যার প্রমাণ মিলেছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে এমএমসি ড্যাশবোর্ডের সাম্প্রতিক মনিটরিং রিপোর্টে। জেলা শিক্ষা অফিসগুলোর মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম মনিটরিং ও ই-নথি ব্যবস্থাপনা নিয়ে দুই ক্যাটাগরিতে এ মূল্যায়ন করা হয়। এ মূল্যায়ন অনুসারে, ই-নথি ব্যবস্থাপনায় গোপালগঞ্জ জেলা শিক্ষা অফিস ৬৪টি জেলার মধ্যে ৬৩তম হয়েছে। ৬৪তম হয়েছে চট্টগ্রাম জেলা শিক্ষা অফিস। মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম ব্যবস্থাপনায় (এমএমসি) এ জেলার অবস্থান ৪৮তম। এভাবে ই-নথি ব্যবস্থাপনায় মাদারীপুর ৫৬তম, শরীয়তপুর ৫৩তম, রাজবাড়ী ৪৮তম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ৪১তম এবং লক্ষ্মীপুর, সিলেট জেলা শিক্ষা অফিস ২৫তম হয়েছে। মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের ক্ষেত্রে হবিগঞ্জ ৫৬তম, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ৫৯তম, বগুড়া ৬১তম, ঝালকাঠি ২৪তম, পিরোজপুর ১৮তম অবস্থানে রয়েছে। এভাবে চট্টগ্রাম, ভোলা, কিশোরগঞ্জ, জামালপুর, নেত্রকোনা, শেরপুর, কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী ও বান্দরবান জেলা শিক্ষা অফিসও এ মনিটরিং রিপোর্টে র্যাঙ্কিংয়ে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে।