ডিজিটাল হুন্ডি রেমিটেন্সে টান
ডিজিটাল হুন্ডির কারণে বৈধ পথে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স কমছে। হুন্ডি ব্যবসায়ীরা এর জন্য মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিসেস (এমএফএস) প্ল্যাটফর্ম বেছে নিয়েছে। কিছু অসাধু এজেন্ট এই অপরাধে জড়িত। ফলে প্রবাসী বাংলাদেশি জনশক্তি রপ্তানি বাড়লেও দেশে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ কমেছে। বিএফআইইউর দ্বারা প্রদত্ত তথ্যের ভিত্তিতে, কিছু MFS প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে ৫.৪১৯ এজেন্সি বাতিল করেছে। অন্যদিকে, অবৈধ গেমিং, বাজি বা জুয়া এবং অনলাইন ফরেক্স ট্রেডিংয়ের মাধ্যমে নগদ ডলার পাচার করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) বিশেষ অনুসন্ধানে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। আর এ বিষয়ে বিস্তারিত তদন্ত শুরু করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রবাসীদের কাছ থেকে উন্নয়ন, নগদ অর্থসহ বিভিন্ন এমএফএস প্রতিষ্ঠানের নামে একটি চক্র অবৈধভাবে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করছে বলে বিএফআইইউ জানতে পেরেছে। হুন্ডি চক্রের সদস্যরা এমএফএস অ্যাকাউন্ট নম্বর এবং প্রবাসী সুবিধাভোগীর পরিমাণ উল্লেখ করে অ্যাপস বা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশি এজেন্টদের এসএমএস পাঠাচ্ছেন। এখানকার এজেন্ট সুবিধাভোগীর নম্বর ক্যাশ করছে। এ কারণে বৈদেশিক মুদ্রায় প্রবাসীদের টাকা দেশে আসছে না।
জানা গেছে, বিদেশে বিভিন্ন এমএফএসের সাইনবোর্ড টানিয়ে প্রবাসীদের কাছ থেকে অর্থ আদায়কারী সংস্থার বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট দেশের বাংলাদেশি দূতাবাসকে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে গত ১১ আগস্ট বিএফআইইউ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়। অন্যদিকে তদন্ত ও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রতিবেদন সিআইডিতে পাঠানো হয়েছে।
বিএফআইইউ -এর তদন্তে আরও জানা গেছে যে MFS এবং কিছু ক্ষেত্রে অনলাইন গেমিং, বেটিং, ক্রিপ্টোট্রেডিং বা অনলাইন ফরেক্স ট্রেডিংয়ের জন্য ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করা হচ্ছে। এই প্রক্রিয়ায় কিছু অসাধু MFS এজেন্ট ‘ক্যাশ আউট’ করতে আসে এবং খোলা বাজার থেকে ডলার কিনে ওইসব অনলাইন সাইটের অপারেটরদের কাছে পাচার করে। এই ধরনের বেশিরভাগ সাইট ভারত এবং চীন থেকে পরিচালিত হয়।
দেশে বেশ কিছুদিন ধরেই ডলারের সংকট চলছে, যার অন্যতম কারণ রেমিটেন্স কমে যাওয়া। ব্যাংক ছাড়াও খোলা বাজারেও ডলারের দর বেড়েছে। চলতি বছরের শুরুতে খোলা বাজারে প্রতি ডলারের দাম ছিল ৯০ টাকার কাছাকাছি। সম্প্রতি যা সর্বোচ্চ রুপিতে উঠেছে। ১১৯. কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনসহ নানা উদ্যোগের পর দর এখন ১০৬ টাকা থেকে ১১০ টাকায় নেমে এসেছে। আবার আমদানি পর্যায়ে ডলারের দাম যা ছিল ৮৬ টাকা, তা বেড়ে ১১২ টাকায় দাঁড়িয়েছে। যা এখন কিছুটা কমে ১০৪ থেকে ১০৬ টাকা হয়েছে। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কমে যাওয়ায় এভাবেই ডলারের দাম বেড়েছে। এ কারণে বাজারে পণ্যের দাম বেড়েছে।
জানা গেছে যে বিএফআইইউ ডিজিটাল হুন্ডি এবং এমএফএস প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে অবৈধ গেমিং, বেটিং, ক্রিপ্টোট্রেডিং বা অনলাইন ফরেক্স ট্রেডিং সম্পর্কিত লেনদেন সনাক্ত করতে মোট ৪ লাখ এমএফএস এজেন্টের ডেটা বিশ্লেষণ করেছে। চারটি সূচকের ভিত্তিতে গত এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত লেনদেন বিশ্লেষণ করে প্রাথমিকভাবে ১ লাখ ৮১ হাজার ৫০৫টি সন্দেহজনক লেনদেন শনাক্ত করা হয়েছে। এই সূচকগুলির মধ্যে একটি হল এজেন্ট সংখ্যা যেখানে মোট লেনদেনের ৯০ শতাংশ বা তার বেশি শুধুমাত্র ‘ক্যাশ ইন’ হয়। অন্যান্য সূচকের মধ্যে রয়েছে মোট লেনদেনের ৯০ শতাংশেরও বেশি যেখান থেকে শুধুমাত্র ‘ক্যাশ আউট’ হয়, এক মিনিটে চার বা তার বেশি ‘ক্যাশ ইন’ এবং দুপুর ২টা থেকে সকাল ৬টার মধ্যে ‘ক্যাশ ইন’। প্রাথমিকভাবে বিকাশের ৬৯ হাজার ৬১৩ জন, আওয়ায়ার ৩৮ হাজার ৮৩৫, রকেটের ৩৮ হাজার ৩৫৮ এবং ক্যাশের ৩৪ হাজার ৩৫৮ জন এজেন্টকে সন্দেহজনক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এরপর সংশ্লিষ্ট এমএফএস সংস্থাকে এসব এজেন্টদের তথ্য দিয়ে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। সেই আলোকে এজেন্সি বাতিল করেছে ৫ হাজার ৮৯ জনের। এ ছাড়া আরও ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত ৩৩০ এজেন্টের এজেন্সিও বাতিল করা হয়েছে। সব মিলিয়ে ৫ হাজার ৪১৯ বাতিল এজেন্টের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে সিআইডিকে তথ্য দেওয়া হয়েছে।
বিকাশের চিফ এক্সটার্নাল অ্যান্ড কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার মেজর জেনারেল (অব.) শেখ মোঃ মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘কমপ্লায়েন্স নীতির বাইরে যেকোনো লেনদেন প্রতিরোধে বিকাশ সবসময় সক্রিয় ভূমিকা পালন করে আসছে। আমরা বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বিএফআইইউ-এর নীতিমালা অনুযায়ী মাঠ পর্যায়ে নিয়মিত লেনদেন তদারকি ও যাচাই করি। প্রয়োজনীয় ঝুঁকি প্রশমনের ব্যবস্থা নিন। এছাড়া প্রথা অনুযায়ী সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য তুলে ধরি। হুন্ডি প্রতিরোধে নিয়ন্ত্রক সংস্থার বর্তমান উদ্যোগকে আমরা পূর্ণ সহযোগিতা করছি।
নগদ এর হেড অব কমিউনিকেশন মুহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম সজল বলেন, ‘নগদ সবসময় ডিজিটাল হুন্ডির বিরুদ্ধে সোচ্চার। আমরা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে যেকোনো সন্দেহজনক লেনদেন প্রতিরোধ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। নগদে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে, কোনো এজেন্টের কাছ থেকে লেনদেনের কোনো আকস্মিক বৃদ্ধি স্বয়ংক্রিয়ভাবে
একটি লাল সংকেত তৈরি করে। হঠাৎ করে কেন লেনদেন বেড়ে গেল তা পরীক্ষা করার জন্য কোনো অস্বাভাবিকতা পরিলক্ষিত হলে বিএফআইইউ-তে সন্দেহজনক লেনদেন প্রতিবেদন (এসটিআর) করা হয়।