চা শ্রমিকদের আন্দোলন।নেতাদের ওপর অনাস্হায় কাটছে না অচলাবস্থা
চা শ্রমিকদের আন্দোলন শেষ হয়নি। পর্যায়ক্রমে সমঝোতা বৈঠক শেষে নেতারা আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দিলেও সাধারণ কর্মীরা তা প্রত্যাখ্যান করেন। অতীতে বাংলাদেশ চা সমিতি ও শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের ‘আশ্বাসে’ আস্থা রেখে প্রতারিত হয়েছেন বলে অভিযোগ করছেন শ্রমিকরা। সেই আস্থার সংকট দেশের চা শিল্পের অচলাবস্থা নিরসনের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সরাসরি বা কার্যত প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আশ্বাস শোনার অপেক্ষায় শ্রমিকরা।
গত রোববার রাতে সিলেটে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সমঝোতা বৈঠকে কোনো সমাধান হয়নি। একই সময়ে মৌলভীবাজারে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অনুরূপ সভা অনুষ্ঠিত হয়। বেলা ৩টার দিকে সভা শেষে চা শ্রমিক নেতারা প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আস্থা ও শ্রদ্ধা জানিয়ে ধর্মঘট প্রত্যাহারের ডাকে সাড়া দেন। এমনকি নতুন নির্ধারিত ১৪৫ টাকার পরিবর্তে ১২০ টাকা পূর্বের মজুরিতে কাজে যোগদানের সিদ্ধান্তেও সম্মত হয়েছেন নেতারা। এছাড়া শারদীয় দুর্গাপূজার আগে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সের আয়োজন করার অনুরোধ জানান শ্রমিক নেতারা। আশ্বাস পেয়ে কিছু প্ল্যান্টেশন শ্রমিক কাজে ফিরে গেলেও অধিকাংশ শ্রমিক আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। এর আগে শনিবার রাতের বৈঠকের পর নেতারা আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দিলেও সাধারণ শ্রমিকরা ধর্মঘট অব্যাহত রাখেন।
সিলেট নগরীর উপকণ্ঠে দেশের প্রথম চা বাগান মালনীছড়ার শ্রমিক পঞ্চায়েত কমিটির সহ-সভাপতি সাধন কালওয়ার জানান, অন্ধকারে সিলেট জেলার ২২টি চা বাগানের উপত্যকা সভাপতি রাজু গোয়ালার করা চুক্তি তারা মানছেন না। রাত রাজু লাক্কাতুরা বাগানের শ্রমিকরা কাজে যোগ দিলেও ধর্মঘট পালন করবে। না খেয়ে মারা গেলেও দৈনিক মজুরির ৩০০ টাকা দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টিভিতে ৩০০ টাকা মজুরি নির্ধারণের ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত তারা কাজে যোগ দেবেন না। প্রয়োজনে এক থেকে দুই মাস আন্দোলন চলবে।
মৌলভীবাজারের শমশেরনগরের কানিহাটি চা বাগানের শ্রমিক পরিবারের সন্তান সন্তোষ রবিদাশ অঞ্জন বলেন, চা বাগান মালিকরা শ্রমিকদের যে সুযোগ-সুবিধা দেন তা কাল্পনিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রাক্তন শিক্ষার্থী বলেন, তাদের কল্পিত পরিসংখ্যান দিয়ে দৈনিক মজুরি ৪০২ টাকা হিসাব জল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়।
অচলাবস্থার নিষ্পত্তি না হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আন্দোলন শুরুর আগে শ্রমিক নেতারা বলেছিলেন, ৩০০ টাকার এক পয়সা কম দিলেও তারা চুক্তিতে সই করবেন না। এখন তারা সাধারণ শ্রমিকদের না জানিয়ে রাতের আঁধারে দরকষাকষি করছেন। এতে প্রতারিত বোধ করছেন শ্রমিকরা। শ্রমিক নেতাদের অতীত ইতিহাস সুখকর না হওয়ায় আস্থা ও অবিশ্বাসের দোলাচল রয়েছে।
গত ১০ দিনের আন্দোলনের পেছনে বাইরের ইন্ধন রয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। তবে সাধারণ শ্রমিকরা তাদের দাবিতে অনড়। এমনকি প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠকে সমঝোতায় রাজি হওয়ায় শ্রমিক সংগঠনের বিভিন্ন স্তরের নেতারা সাধারণ শ্রমিকদের হাতে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হয়েছেন।
মৌলভীবাজারে ৯২টি, হবিগঞ্জে ২৪টি এবং সিলেটে ২২টি চা বাগান ছাড়াও এর আওতায় অনেক ফাঁড়ি বাগান রয়েছে। দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে ১৩ আগস্ট থেকে এসব বাগানের শ্রমিকরা অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট শুরু করেন। তারা বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ করে।
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের মিটিঙ্গা চা বাগানের কর্মী সঞ্জয় বাউরী জানান, পঞ্চায়েত কমিটির নেতা ও উপত্যকা ও চা শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে বৈঠক ফলপ্রসূ হয়নি। আন্তরিক সম্পর্কের জন্য অন্তরঙ্গ যোগাযোগের প্রয়োজন। কিন্তু সাধারণ কর্মীদের সঙ্গে উপত্যকা বা কেন্দ্রীয় নেতাদের কোনো যোগাযোগ নেই। তাদের মধ্যে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সম্পর্ক না থাকায় কেন্দ্রীয় নেতাদের আস্থা রাখতে পারছেন না তারা।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ কান্দ ও শ্রমিক সংগঠনের সহ-সভাপতি নিপেন পালের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। অন্য শ্রমিক নেতারাও আন্দোলন নিয়ে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হবিগঞ্জের এক শ্রমিক নেতা বলেন, অতীতে নেতারা সাধারণ শ্রমিকদের দাবি পূরণে ব্যর্থ হয়েছেন।