টিকে থাকার চ্যালেঞ্জ বাড়ল
ডিজেল-কেরোসিনের মতো জ্বালানিকে জীবনযাত্রার ব্যয়ের ‘সংক্রামক’ পণ্য হিসাবে বিবেচনা করা হয়। দাম বাড়ার সাথে সাথে সংসারের খরচও বেড়ে যায়। জীবনের গতি থেমে যায়। জ্বালানি তেলের রেকর্ড দাম সাধারণ মানুষের ওপর চাপ বাড়াবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। করোনা মহামারীর পর মানুষ ইতিমধ্যেই ধোলাই করছে। তার ওপরে দেশের পণ্যবাজার অস্থিতিশীল এমন এক সময়ে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
গত ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। তারপর কয়েক বছরের মধ্যে অপরিশোধিত তেলের দাম শীর্ষে ওঠে। একটি ব্যারেলের দাম ১১০ ডলারে থেমেছে। যাইহোক, এটি সম্প্রতি ৯৪ ডলারে নেমে এসেছে। জ্বালানি তেলের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় অভ্যন্তরীণ বাজারে দাম সমন্বয় করেনি বাংলাদেশ। তবে বিশ্ববাজারে দরপতনের কারণে গত শুক্রবার রাতে দেশে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৫১ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত করে সরকার।
এদিকে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার প্রেক্ষাপটে শনিবার রাতে দূরপাল্লার বাসের ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ৪০ পয়সা বাড়িয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। আর মহানগরে বাস ও মিনিবাসের ভাড়া কিলোমিটার প্রতি ৩৫ পয়সা করে বাড়ানো হয়েছে।
পরিবহন খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডিজেলের নতুন দামের কারণে বাসের পাশাপাশি লঞ্চের ভাড়াও বাড়বে। ট্রাক ব্যবসায়ীরা বলছেন, তাদের খরচ আরও বাড়বে। রড, স্টিল ও সিমেন্ট খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, তাদের উৎপাদন খরচ ৫ থেকে ৭ শতাংশ বাড়বে। উৎপাদন ও পরিবহন খরচ ১০ শতাংশ বাড়তে পারে বলে জানিয়েছে খাদ্য নির্মাতারা। তারা বলছেন, কাঁচামাল আনতে খরচ যেমন বাড়বে, তেমনি তৈরি পণ্য সরবরাহেও বাড়তি খরচ হবে।
আর অর্থনীতিবিদরা বলছেন, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে মুদ্রাস্ফীতি দ্রুত বাড়বে। সরকারি ভর্তুকি খরচ কিছুটা কমতে পারে। তবে হঠাৎ করে জ্বালানির দাম বাড়ায় সাধারণ মানুষের জীবন ধারণ বা বেঁচে থাকা চ্যালেঞ্জ বাড়তে পারে। সময়মতো উদ্যোগ না নেওয়ার দায় চাপানো হয়েছে জনগণের ওপর। এখন কৃষি ও শিল্প খাতের উৎপাদন খরচ বাড়বে। সকল খাদ্য ও অখাদ্য সামগ্রীর দাম বৃদ্ধি পাবে, যা মূল্যস্ফীতিকে বাড়িয়ে দেবে। এতে দারিদ্র্য, অপুষ্টি ও বৈষম্য বাড়বে। শিল্প খাতের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমে যাবে। তারা বলছেন, জ্বালানির মূল্য সমন্বয়ের বাস্তবতা রয়েছে। কিন্তু একবারে এতটা না বাড়িয়ে ধাপে ধাপে করা যেত। মানুষকে মানিয়ে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিত ছিল।
বিশেষজ্ঞরা সুপারিশ করেছেন যে পরিস্থিতি মোকাবেলায় জ্বালানির দাম বাড়ানো থেকে সরকারের সঞ্চয় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মাধ্যমে নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে সরাসরি যায়। তারা নিম্ন আয়ের প্রবীণ, বিধবা, গর্ভবতী নারী এবং শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের জন্য সরকারি ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাবও করেছে। তারা বলেন সাশ্রয়ী মূল্যে খাদ্য সরবরাহ বাড়াতে হবে, যাতে গ্রাম এবং শহরের সমস্ত নিম্ন আয়ের লোকদের অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। তা না হলে দারিদ্র্য ও বৈষম্য বাড়বে এবং নিম্ন আয়ের মানুষের পুষ্টি পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি ঘটবে।
সিপিডির অনারারি ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, এই দুর্যোগের সময়ে জ্বালানি তেলের দাম এত বাড়ানোর সিদ্ধান্ত বেপরোয়া ও অনৈতিক। সরকারের এ সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির গভীর কাঠামোগত সমস্যা প্রকাশ পেয়েছে। সরকার আর্থিক একত্রীকরণের মাধ্যমে অর্থনীতি পরিচালনা করতে পারেনি। কর আদায়ের হার কম থাকায় এই সংকটময় সময়ে সরকারের কোনো ব্যয়যোগ্য সম্পদ নেই। ভর্তুকি রক্ষা করার ক্ষমতা নেই। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিভিন্ন সময়ে কাঠামোগত সংস্কার না করার অনিবার্য ফল এই সিদ্ধান্ত। ফলে সীমিত ও স্থায়ী আয়ের মানুষরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। বাজারে পণ্যের দাম বাড়ায় যাদের আয় বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। তিনি বলেন, “আমি মনে করি, সরকারের এই সিদ্ধান্তে আইএমএফের ‘সাক্ষী গোপাল’ হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। আমাদের নিজেদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমাদের অর্থনীতি ভালো না খারাপ। আমাদের অনুভব করতে হবে যে আমরা আমাদের ত্যাগ করেছি। আইএমএফের উপর চাপ দিয়ে নীতি সার্বভৌমত্ব।”