ডলার যাচ্ছে কোথায়
হজের জন্য ডলার কেনার ডামাডোল অনেক আগেই চলে গেছে। সরকারি কর্মকর্তা ও ব্যাংকারদের বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা। এই করোনা-পরবর্তী সময়ে বিদেশ ভ্রমণে অনেক ঝুঁকি রয়েছে; বিধিনিষেধও আছে। তারপরও ডলারের বাজারে আগুন জ্বলছে। মানি চেঞ্জার এবং খোলা বাজারে ডলারের চাহিদা অস্বাভাবিক গতিতে বাড়ছে। একদিনের ব্যবধানে গতকাল মঙ্গলবার ৮ টাকা বেড়ে প্রতি ডলার বিক্রি হয়েছে দেশের খোলা বাজারে সর্বোচ্চ ১১২ টাকা, যা এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ দাম।
গত কয়েকদিনে, খোলা বাজারে প্রচুর পরিমাণে ডলার কেনার চাহিদা দেখা গেছে, যা ব্যক্তিগত বিদেশ ভ্রমণের জন্য মানুষের স্বাভাবিক চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠেছে, এত ডলার কোথায় যাচ্ছে, ডলার কি পাচার হচ্ছে? সাম্প্রতিক সময়ে চোরাচালানের কোনো প্রমাণ না থাকলেও কিছু লোক বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে ডলার কিনছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
জানা গেছে, মানুষ সাধারণত বিদেশ ভ্রমণ, চিকিৎসা, প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা সংক্রান্ত খরচের জন্য খোলা বাজার বা ব্যাংক থেকে ডলার কেনেন। গতকাল ব্যাংকে নগদ ডলার ৫ টাকা বেড়ে ১০৬ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এর আগে গত রোববার খোলা বাজারে দাম আড়াই টাকা বেড়ে ১০৫ টাকা হয়। গত ১৭ মে প্রথমবারের মতো এই বাজার ১০০ টাকা ছাড়িয়েছে। তারপর আবার কমেছে। এটি ১৭ আগস্ট আবার ১০০ টাকা অতিক্রম করে।
মানিচেঞ্জারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি একেএম ইসমাইল হক বলেন, গত কয়েকদিন ধরে ডলারের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। গতকাল ডলার বিক্রি হয়েছে ১১২ টাকা পর্যন্ত। কেন এভাবে দাম বাড়ছে তার সঠিক কারণ তারা জানেন না। তবে অনেকেই হয়তো রেট বাড়বে ভেবে ডলার মজুদ করছেন। চোরাচালান বা অন্য কিছু হচ্ছে কিনা ধারণা নেই।
দেশে ৬০২টি অনুমোদিত মানি চেঞ্জার রয়েছে, যার মধ্যে ২৩৫টি বৈধ। বাকিদের লাইসেন্স স্থগিত বা বাতিল করা হয়েছে। মানি চেঞ্জারের প্রতিদিনের লেনদেনের তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠাতে হবে। যাইহোক, অনেক মানিচেঞ্জার এজেন্ট নিয়োগ করে, যারা প্রতিষ্ঠানের বাইরের ক্লায়েন্টদের কাছ থেকে ডলার ক্রয় এবং বিক্রি করে। এ ধরনের লেনদেন অবৈধ।
জানা গেছে যে কিছু মানিচেঞ্জার যাদের লাইসেন্স স্থগিত বা প্রত্যাহার করা হয়েছে তারা ডলারের অবৈধ ব্যবসায় জড়িত। মানিচেঞ্জারদের বাইরে ব্যক্তি-থেকে-ব্যক্তি লেনদেনের জন্য কোনও কাগজপত্রের প্রয়োজন নেই। এমন কয়েকজন বিক্রয়কর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সম্প্রতি তারা মোটা অঙ্কের ডলার কেনার অর্ডার পাচ্ছেন। একজন কর্মচারী জানান, একজন গ্রাহক ধাপে ধাপে ২০,০০০ ডলারের ক্রয়ের অর্ডার দিচ্ছেন। কেউ কেউ অগ্রিম টাকা নিয়ে পরে ডলার দেয়।
বিদেশ ভ্রমণ, চিকিৎসা, শিক্ষা, সেমিনারে অংশগ্রহণের জন্য সব ক্রেতাই এসব ডলার কিনছেন না। তাদের মতে, ব্যাংকিং খাতে কড়াকড়ির কারণে এক শ্রেণির মানুষ ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে নগদ ডলার কিনছে। আরেক ক্যাটাগরি শেয়ার বাজারের মতো ডলারে বিনিয়োগ করছে। সঞ্চয়পত্রে কঠোরতাসহ নানা কারণে দুর্নীতির টাকা দিয়ে ডলার কিনছেন কেউ কেউ। তারা বিশ্বাস করে ডলার পাচার হতে পারে।
জানতে চাইলে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, সাধারণত সংকটের সময় বেশি কিছু কেনার প্রবণতা থাকে কিছু মানুষের। তার মতে, ডলারের খোলা বাজারে এমনটা হতে পারে। কেউ কেউ ইচ্ছে করে ডলার কিনছে। দাম বাড়বে বলে মনে করছেন তারা। তিনি বলেন, নির্বাচনের আগে মানি লন্ডারিং বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। ডলার পাচার হচ্ছে কিনা তা সংশ্লিষ্ট সংস্থা খতিয়ে দেখতে পারে। বিশ্বব্যাপী আমদানি-রপ্তানির মূল্য কমিয়ে অর্থ পাচারের প্রবণতা রয়েছে। বাংলাদেশের খোলা বাজারে ডলারের দর অস্বাভাবিক অবস্থায় চোরাচালানের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলেন, আমদানি ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়ায় ডলারের চাহিদা বেড়েছে। চাহিদা মেটাতে ডলার সরবরাহ করতে না পারায় দাম বাড়ছে। তিনি বলেন, আমদানি বাড়ার পেছনে অর্থপাচার দায়ী। কারণ সেখানে ব্যাপক ওভার ইনভয়েসিং আছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে কঠোর আমদানি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এটা না করলে ডলার পাচার রোধ করা যাবে না।
ব্যাংক পরিস্থিতি: বেশ কিছুদিন ধরেই ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলারের দর বাড়ছে। ব্যাংকগুলোর আমদানি দায় মেটাতে বাংলাদেশ ব্যাংকও ডলার বিক্রির হার বাড়াচ্ছে। গতকাল কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৯৪ টাকা ৭০ পয়সা দরে ৫ কোটি ডলার বিক্রি করেছে। এই হারে এক ব্যাংক অন্য ব্যাংকের কাছে ডলার বিক্রি করার কথা। তবে আন্তঃব্যাংক লেনদেন নেই।