জাতীয়

৯ তরুণের খোজ নেই এক থেকে দেড় বছর

শেখ আহমদ মামুন (২০) সিলেটের লিডিং ইউনিভার্সিটির ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের ছাত্র ছিলেন। ছয় মাস ধরে তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পরিবারের পক্ষ থেকে ওসমানীনগর থানায় জিডিও করা হয়েছে। তবে তার অবস্থান সম্পর্কে কোনো তথ্য দিতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। একই দিনে সিলেটের আরও তিন যুবক মামুনের সঙ্গে বাড়ি থেকে বের হয়। তাদের হদিস এখনো মেলেনি। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দেড় বছর ধরে মোট ৯ যুবক নিখোঁজ হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

সমসাময়িক তদন্ত এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মতে, তারা চরমপন্থায় জড়িত থাকার কারণে তথাকথিত অভিবাসনের উদ্দেশ্যে তাদের বাড়িঘর ছেড়েছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ গোপন ডরমিটরিতে প্রশিক্ষণও সম্পন্ন করেছে। এসব তরুণ নিখোঁজ হওয়া নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে উদ্বেগ রয়েছে। নিখোঁজদের পরিবারের সঙ্গে বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে সময়ে সময়ে যোগাযোগ করা হয়েছে এবং তথ্যপ্রযুক্তি তদন্ত করেও তাদের আইনের আওতায় আনা যায়নি।

নিখোঁজ শেখ আহমেদ মামুনের বাবা শেখ শামসুল হক স্বপন পল্লী বিদ্যুৎে চাকরি করেন। তিনি বলেন, “ছয় মাস ধরে ছেলের খোঁজ করছি না। সব বাহিনীর লোকজন আমার বাড়িতে এসেছে। কেউ ছেলেকে খুঁজে পায়নি। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে অপরাধ থেকে পালানো কঠিন। আমার ছেলে। খুঁজে পাওয়া যায় নি।

পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) প্রধান ডিআইজি মো. আসাদুজ্জামান বলেন, নিখোঁজদের মধ্যে কয়েকজন ‘দেশান্তরিত’ হয়েছে। তারা জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িত। তাদের আইনের আওতায় আনার জন্য আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশিদ বলেন, যতদিন উগ্রবাদী মতাদর্শ মস্তিষ্কে সক্রিয় থাকবে ততদিন যে কেউ বিভ্রান্ত হয়ে বাড়ি থেকে বের হতে বাধ্য হতে পারে। জঙ্গি মতাদর্শের কারণে কেউ বাড়ি থেকে বের হলে হামলার আশঙ্কা থাকে। যারা ধর্মের নামে কিশোর-তরুণদের ব্যবহার করতে চায় তাদের প্রতি নিয়ত নজরদারি করতে হবে। আক্রমণ না হওয়ায় তারা আবার আক্রমণ করবে না তা বলা যাবে না। ডি-র্যাডিক্যালাইজেশন কর্মসূচির আওতায় তরুণদের সঠিক পথে রাখতে ‘সফট পাওয়ার’ ব্যবহার করতে হবে। জঙ্গি তৎপরতা প্রতিরোধে পরিবার ও সমাজের সবচেয়ে বেশি তৎপর হওয়া জরুরি।

২০১৬ সালের জুলাইয়ে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পর জঙ্গিবাদের কারণে দেশত্যাগের উদ্দেশ্যে ঘরবাড়ি ছেড়ে আসা অন্তত ৪০ জনের নাম বেরিয়ে আসে। তাদের কেউ কেউ ইরাক ও সিরিয়ায় চলে গেছে। ইসলামিক স্টেট (আইএস) লড়াইয়ে মারা যাওয়া চারজনের ছবিও প্রকাশ করেছে। হলি আর্টিসানে হামলার ১৬ দিন পর নিখোঁজ ২৬২ জনের তালিকা প্রকাশ করেছে র‌্যাব। পরে সংশোধন করে ৭০ জনের তালিকা প্রকাশ করা হয়।

সিলেটের ওসমানীনগর উপজেলা থেকে গত বছরের ১৫ নভেম্বর বাড়ি থেকে বের হওয়া অপর তিন যুবক হলেন ছোরাব আলী হাসানের ছেলে হাসান সাঈদ, সিরাজুল ইসলামের ছেলে ছাদিকুর রহমান ও মানিক মিয়ার ছেলে সাইফুল ইসলাম তুহিন। তারা তাবলিগ জামাতে যাওয়ার কথা বলে বাড়ি থেকে বের হন। মোবাইল ফোন বন্ধ থাকায় এবং পরিবারের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ না হওয়ায় গত ২৮ নভেম্বর পরিবারের লোকজন ওসমানীনগর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন।

হাসান সাঈদের পরিবার জানায়, সাঈদ ২০১৮ সালে ঢাকার একটি মাদ্রাসা থেকে খেতাব পাস করেন। বাড়িতে থাকত, পরিবারের দেখাশোনা করত। নিখোঁজ হওয়ার পাঁচ মাস আগে তার বিয়ে হয়। বিদেশী ধর্ম প্রচারক এই বলে বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন যে তিনি ধর্মসভায় যোগ দেবেন। নিখোঁজ ছাদিক ওসমানীনগরের দয়ামীর বাজারের একটি জিমনেশিয়ামে পরিদর্শক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। নিখোঁজ সাইফুল ইসলাম তুহিন স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় কিছুদিন পড়ালেখা বন্ধ করে দেন। সম্প্রতি তিনি ওসমানীনগরের একটি গ্যারেজে নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। কিন্তু পরিবার তাকে মধ্যপ্রাচ্যে পাঠানোর চেষ্টা করছিল। তবে বাড়ি ছাড়ার আগে তিনি তার পরিবারের সঙ্গে ধর্মপ্রচারের কথা বলছিলেন।

এছাড়া গত বছর সিলেট থেকে নিখোঁজ হওয়া আরও দুই যুবক এখনো নিখোঁজ রয়েছে। তারা হলেন আব্দুর রাজ্জাক ও শিব্বির আহমেদ। রাজ্জাকের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায়। তবে সিলেটে ভাইয়ের সঙ্গে থাকতেন। আর মদন মোহন তখন কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে পড়ত।

এক দশকেরও বেশি সময় ধরে জঙ্গি তৎপরতার ওপর নজরদারি করছেন এমন দুই উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, রাজ্জাক ও শিব্বির নিখোঁজ এবং অন্য একজনের নিখোঁজ হওয়ার খবর তারা পেয়েছেন। ওই যুবকের নাম সাদ আল নাহিদ নাহিয়ান। তার গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের তাড়াইলের কাজলে। তিনি ঢাকার উত্তরায় থাকতেন। নাহিয়ান দুটি জঙ্গি মামলার আসামি। দেড় বছর আগে জামিন পান তিনি। বেশ কিছুদিন ধরে তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। একই দিনে সিলেটের দুইজন ও তাড়াইল থেকে একজন নিখোঁজ হন। নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল-ইসলামের (সাবেক আনসারুল্লাহ বাংলা টিম-এবিটি) সঙ্গে তাদের যোগসূত্রের তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা। তাড়াইলের ওই যুবক সাবেক মন্ত্রীর ভাগ্নে।

সিটিটিসির একজন কর্মকর্তা জানান, রাজ্জাক, শিবির এবং আরও কয়েকজন চরমপন্থী যোগাযোগ রাখার জন্য তাদের নিজস্ব টেলিগ্রাম চ্যাট গ্রুপ তৈরি করেছিল।

মন্তব্য করুন