৬৩৮তম ওরশে আশরাফী স্মরণে:
ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম ইসলাম প্রচারক কাছওয়াছা শরীফের প্রাণপুরুষ তারেকুচ্ছালতানাত,কুদওয়াতুল কুবরা,মাহবুবে ইয়াজদানী, গাউছুলআলম, মখদুম সোলতান আউহাদুদ্দীন মীর সৈয়দ আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানী (রাঃ) –সৈয়দ মুহাম্মদ মুনিরুল ইসলাম আশরাফী
ভুমিকা- ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম সফল ইসলাম প্রচারক বাদশাহী পরিত্যাগী সুফী গাউছুল আলম মাহবুবে ইয়াজদানী সৈয়দ আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানী (রাঃ)‘র ৬৩৮ তম পবিত্র ওরশে আশরাফী উপলক্ষ্যে ওনার জীবন ও সাধনার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা উপস্থাপন করলাম। এই মহান সুফী দরবেশের জীবন নিয়ে সংক্ষিপ্ত পরিসরে আলোচনা করা দুঃসাধ্য ব্যাপার যাঁর জন্ম থেকে শুরু করে পুরো ১২০ বছরের জীবন আধ্যাত্মিকতা ও অলৌকিকতায় সমৃদ্ধ । এ মহান সাধকের জন্মই হলো পিতা মাতার আরাধ্য সাধনা ও মোনাজাতের মাধ্যমে প্রভুর পক্ষ হতে নেয়ামত। জন্মের পূর্বেই সুসংবাদ দেয়া হলো দুই জন সন্তানের আগমন হবে একজনের নাম হবে আশরাফ অপরজন আরাফ প্রথমজন আধ্যাত্ম সাধনার মাধ্যমে জগতে খ্যাতি অর্জন করবে অপরজন মানব সেবায় বিখ্যাত হবে। চার বছর চার মাস চার দিন বয়সে শিক্ষার হাতেখড়ি অতঃপর ১৪ বছরে হাফেজে কুরআন, কুরআন হাদিস ও ফিকাহ সহ অন্যান্য বিষয়ে বুৎপত্তি লাভ। যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শিতা অর্জন করে ১৫ বছর বয়সে সিমনান রাজ্যের দায়িত্ব গ্রহন ২৩ বছর বয়সে ছোট ভাইয়ের হাতে রাজ্যের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে আধ্যাত্মিক নির্দেশনায় সিমনান হতে সূদুর বাংলায় পীর ও মুর্শীদের কাছে নিজেকে সমর্পণ। সুদীর্ঘ ২ বছরের সফরে অসংখ্য আউলিয়ায়ে কেরাম পীর বুজুর্গগণের সাক্ষাত করে নেয়ামত লাভে ধন্য হওয়া। এই বিশাল বর্ণাঢ্য জীবন নিয়ে লেখা সত্যিই সহজসাধ্য ব্যাপার নয় তারপরও সংক্ষিপ্ত পরিসরে পরিচয় দেয়ার প্রচেষ্ঠা মাত্র।
জন্ম- ১২৮৫ সাল, ৭০৮ হিজরী ১৩০৮সালে সিমনান, ইরান।
ওফাত- ১৪০৫সাল, ১৩৮৬বঙ্গাব্দ, ৮০৮ হিজরী ২৮ শে মহররম, কাছওয়াছা, আম্বেদকর নগর, ভারত।
পিতা- সুলতান ইব্রাহীম নুর বখসী কুতুবউদ্দীন সিমনানের সুলতান (হযরত হোসেন ইবনে আলীর বংশ থেকে তার কন্যা ফাতিমার মাধ্যমে নবী করিম (সঃ) এর বংশধারা
মাতা- বিবি খাদিজা (তুর্কি সুফি সাধক আহমদ ইয়াসাভির বংশধর)
পূর্বসুরী- হযরত শায়েখ আলাউল হক ওয়াদ্দীন গঞ্জেনাবাত পান্ডুবী (রাঃ)
উত্তরসূরী- হযরত আবদুর রাজ্জাক নুরুল আইন (রাঃ)
উপাধী- গাউছুল আলম, মাহবুবে ইয়াজদানী, কুদওয়াতুল কুবরা, সুলতান, আশরাফ জাহাঙ্গীর,মখদুম-এ- সিমনানী।
শিক্ষা দীক্ষা- চার বছর চার মাস চার দিন বয়সে শিক্ষার হাতে খড়ি বিসমিল্লাহ শরীফের মাধ্যমে ছবক দেন মাওলানা ইমাদুদ্দী তিরমিজী (রাঃ) অতঃপর পিতার হাতে ধর্ম শিক্ষা শুরু করেন। ৫ বছরে পবিত্র কুরআনুল করীম সাত ক্বেরাত সহকারে হিফজ সম্পন্ন করেন। সাত বছর বয়সে আরবী ভাষার উপর বিশেষ বুৎপত্তি অর্জন করেন। চৌদ্দ বছর বয়সে তিনি কোরআনের তাফসীর, হাদীস শরীফ, ইলমে ফিকাহ সহ প্রচলিত প্রায় সব বিষয়ের উপর গভীর পান্ডিত্য অর্জন করেন এবং অতি অল্প সময়ে যুদ্ধবিদ্যাতেও পারদর্শিতা অর্জন করেন।
সিমনানের সুলতানের দায়িত্ব গ্রহন- আব্বাজানের ইন্তেকালের পর সিমনান রাজ্যের সালতানাতের দায়িত্বভার ১৫ বছর বয়সে গ্রহন করেন। ২৩ বছর বয়সে সিংহাসন ত্যাগ করে ছোট ভাই মুহাম্মদ আরাফের হাতে ন্যস্ত করে আধ্যাত্মিকতার তীব্র আকর্ষনে মায়ের অনুমতিক্রমে হযরত আলাউল হক পান্ডবীর সাথে দেখা করার জন্য বাংলার উদ্দেশে এক সূদীর্ঘ সফর শুরু করেন।
ন্যায় বিচারের দক্ষতা– হযরত শেখ আলাউদ্দৗলা সিমনানী একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন। একদা মাহবুবে ইয়াজদানী হযরত আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানী আমীর ওমরাহ গণের উৎসাহে শিকারে বের হলেন সেখানে অবস্থান কালে এক বৃদ্ধা এসে অভিযোগ করলেন যে,হযরতের সৈন্যবাহিনীর এক সদস্য জোর পূর্বক দই ছিনিয়ে নিয়েছে। হযরত বৃদ্ধাকে সনাক্ত করতে বললে জনৈক সৈন্যের দিকে ইঙ্গিত করলেন। হযরত অভিযোগ সম্পর্কে কৈফিয়ত তলব করলে সৈন্যটি অস্বীকার করল এবং বলল বৃদ্ধা মিথ্যা বলছে। এমতাবস্থায় সাক্ষী ছাড়া ঘটনা প্রমাণের জন্য হযরত কৌশল করে বললেন কিছু মাছি ধরে এনে খাওয়ানোর নির্দেশ দিলে সৈন্যটি বমি করে দিল এবং বমির সাথে দইয়ের কণা বের হলে সত্য প্রকাশিত এবং প্রমাণিত হয়ে গেল। হযরত উক্ত সৈন্যের ঘোড়া ও ঘোড়ার জিন, লাগাম জরিমানা হিসেবে বৃদ্ধাকে দিলেন এবং সৈন্যকে শাস্তি প্রদান করলেন।
অপর ঘটনা হযরত মসনদে বসে দরবার পরিচালনা করছিলেন একজন ছন্নছাড়া দরবেশ মুসাফির এসে অভিযোগ করলেন বিগত রাতে তার কোমরে রক্ষিত চল্লিশটি স্বর্ণমুদ্রা কোন চোর হাতিয়ে নিয়েছে কিন্তু কাফেলার কেউই স্বীকার করছে না। হুজুর যেন এর প্রতিবিধান করেন। হযরত আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানী (রাঃ) তৎক্ষণাৎ ঐ কাফেলার সমস্ত লোককে দরবারে হাজির হতে নির্দেশ দিলেন। তারা শাহী দরবারে এসে বিনীতভাবে চুরির বিষয়টি অস্বীকার করল এবং কসমপূর্বক বলল যে, তারা ফকিরের অর্থ নেয়নি। তখন হযরত আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানী (রাঃ) দরবারে উপস্থিত সভাষদ ও পারিষদবর্গকে লক্ষ করে বললেন যে, এখনতো অর্থ চুরির এ ঘটনা প্রমাণের কোন উপায়ই নাই। তখন ফকির কাঁদতে কাঁদতে বলল, হুজুর আমার অর্থও চুরি হলো আর সকলে কসম করে প্রকারান্তরে আমাকেও অপদস্থ করল।
হযরত আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানী (রাঃ) কিছুক্ষণ মৌন থেকে তারপর সকল লোককে একজন করে নিজের নিকট ডেকে পাঠাতে লাগলেন এবং তাদের বক্ষের উপর নিজ হাত মোবারক স্থাপন করতে লাগলেন। এভাবে দশজন অতিক্রান্ত হলো। একাদশ ব্যক্তির বুকে হাত রাাখার পর তিনি অনুভব করলেন সে লোকের বুকের ভিতর যেন হাতুড়ির পিটুনি চলছে এমনিভাবে তার বুক ধড়পড় করছিল। তখন হযরত আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানী কিছুক্ষণ তার প্রতি পর্যবেক্ষণ করে হুকুম দিলেন ‘উক্ত লোক হতে ফকিরের হারানো স্বর্ণমুদ্রা আদায় করা হবে, একে নিয়ে যাও। ’পরে রাজকর্মচারীগণ একটু চাপ দিতেই সে লোক অভিযোগ স্বীকার করে নিল এবং স্বর্ণমুদ্রাগুলি ফেরত দিল। হযরতের বিচক্ষণতায় প্রতিনিয়তই অপরাধীগণ ধরা পড়ে যেত।
সফর- হযরত আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানী সূদীর্ঘ ২বছর কাল সফর করে অনেক সুফিদের সাথে সাক্ষাৎ করে ফয়েজ ও তাবরুক লাভে ধন্য হয়েছেন সুফিবাদের নিগুঢ় তথ্য সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেছেন। সিমনান হতে প্রথমে বুখারায় পৌছেন সেখানে জনৈক মজজুব দরবেশের সাথে সাক্ষাৎ হলে তিনি পূর্বদিকে নির্দেশ করে অবিলম্বে রওয়ানা হবার নির্দেশ দেন। হযরত বুখারা হতে সমরখন্দের শেখুল ইসলামের সাথে সাক্ষাৎ করে একরাত আতিথেয়তা গ্রহনের পর সঙ্গী সাথী সকলকে মধ্যরাতে ঘুমের মধ্যে রেখে বের হয়ে যান। অনেকদিন পাহাড় জঙ্গল ও অচেনা পথ অতিক্রম করে সিন্ধু প্রদেশের প্রখ্যাত শহর ‘উঝ’ এ পৌছেন এখানে মখদুম জালাল উদ্দিন জাহানিয়া জাহাগঁশত (রঃ) এর সাথে মোলাকাত করে তিনদিন অবস্থান করেন। উনার নির্দেশে হযরত আলাউদ্দিন গঞ্জেনাবাত (রাঃ )‘র সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। দিল্লী পৌছালে সেখানকার বেলায়েতধারী বুজুর্গ বলেন “আশরাফ” তোমাকে স্বাগতম, কিন্তু এখানে তোমার বিলম্ব করা ঠিক হবে না ভাই। আলাউদ্দিন গঞ্জেনাবাত (রঃ } তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন।” অতপর তিনি পূর্বদিকে রওয়ানা হলেন। তিনি পান্ডুয়ার হযরত সুলতানুল মুরশেদীন শেখ আলাউল হক ওয়াদ্দীন (রাঃ)‘র খানেকার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলেন। পীর ও মুর্শীদ পূর্ব হতেই তার আগমনের বিষয় জ্ঞাত ছিলেন। জানা যায় যে হযরত খিজির (আঃ) হযরত আলাউদ্দিন গঞ্জেনাবাতকে তার সম্পর্কে ৭০ বার জ্ঞাত করেছেন। তাই তিনি তার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। হযরত আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানী যখন পান্ডূয়া শরীফের নিকটবর্তী হন তখন হযরত আলাউল হক গঞ্জেনাবাত পান্ডুবী স্বীয় কামরায় আরাম করছিলেন। তিনি অদৃশ্যভাবে জানতে পারলেন হযরত আশরাফের আসার খবর, তিনি পূর্বে থেকেই শীষ্যদের বলে রেখেছিলেন উনার আসার খবর তিনি খানেকার বাইরে এসে বললেন, “বুয়ে ইয়ার মী আয়দ” ‘বন্ধুর সুভাস ভেসে আসছে’ অতপর তিনি সঙ্গী সহচর ও মুরীদসহ বিশাল মিছিল সহকারে স্বীয় খানেকাহ হতে বের হলেন। এক অপূর্ব দৃশ্য। হযরত আলাউল হক অতি বিখ্যাত ও বুজুর্গ ব্যক্তি হিেেসবে বাংলার তৎকালীন বাদশাহর কাছে পর্যন্ত শ্রদ্ধেয় ছিলেন। তিনি যাচ্ছেন একজন মেহমানকে মহাসমাদরে এগিয়ে আনার জন্য। নিশ্চয়ই সেই মেহমান হযরতের কাছে তেমনই প্রিয় ও আদরের।
অবশেষে হযরত আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানী দূর হতে হযরত আলাউল হক পান্ডুবীকে চিনতে পারলেন এবং তিনি দৌড়ে এসে হযরতের ক্বদমে উপুড় হয়ে পড়লেন। হযরত আলাউল হক পান্ডুবী তাড়াতাড়ি সৈয়দ আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানীকে বুকে তুলে নিয়ে বললেন,“ তোমার আসার পূর্বে হযরত খিজির (আঃ) তোমার আসার ব্যাপারে সত্তর বার আমার কাছে এসেছেন এবং বলেছেন যেন তোমার যতেœর ব্যাপারে কোন ঢিলেমি না দেখানো হয়। যেহেতু তুমি আল্লাহর এক আমানত স্বরূপ যা আমার নিকট এসে উপনীত হবে” খানেকায় পৌছে হযরত আলাউল হক পান্ডুবী অতি আদরের সাথে সৈয়দ আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানীকে নিকটে বসালেন এবং বললেন “বৎস! আজ পার্থিব মোহ থেকে হাত ধুয়ে ফেল, নইলে মিলনের মধুরতা থেকে বঞ্চিত থাকতে হবে।” একথা শুনে অতি বিনয়ের সাথে উত্তর দিলেন যে, হ্যাঁ তিনি এ থেকে পূর্বেই পবিত্র হয়েছেন বলে আজ মহান মুর্শিদেও দরবারে হাজির হবার সৌভাগ্য নসীব হয়েছে। তারপর তিনি প্রিয়তম ভক্তকে নিজ হাতে আহার্য মুখে তুলে খাওয়ালেন। ইতোপূর্বে এ পরম সৌভার্গ কারো ললাটে জোটেনি। খাওয়া শেষে তিনি সকল লোককে কামরা থেকে রেরিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত করেন। শুধুমাত্র মীর সৈয়দ আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানী স্বীয় মুর্শিদের সাথে থাকতে পেলেন। পীর ও মুর্শীদ তাকে একাকী বাইয়াত করালেন এবং নেয়ামত দানে সৌভাগ্যবান করলেন। মুর্শীদ তাকে হাতে ধরে কামরার বাইরে এলেন, তখন তাঁর চেহরায় স্বর্গীয় নূরের আভা বিকীর্ণ হতে লাগলো, মুর্শীদ বিভিন্ন পূণ্যময় স্মারক নিয়ে এসে বললেন,“ হে আমার সঙ্গী সাথীরা জেনে রাখ, বুজুর্গানে কেরামের বিভিন্ন স্মৃতি স্মারক দীর্ঘদিন আমার কাছে গচ্ছিত ছিল। এখন এর প্রাপক উপস্থিত হয়েছেন, আমি তাকে এগুলি প্রদান করলাম।” এভাবে পীর ও মুর্শীদ তাকে দিক্ষীত করে নিলেন এবং তিনিও পীরের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করলেন।
জাহাঙ্গীর উপাধী লাভ– হযরত আলাউল হক পান্ডবীর ইচ্ছা হলো তাঁকে কোন উপাধী দেয়া। এ ইচ্ছায় তিনি গায়ব হতে নির্দেশ লাভের অপেক্ষা করতে লাগলেন। একদা শবে বরাতে তিনি অজিফা ও তসবীর জিকিরে নিয়োজিত হন। সারারাত তসবীহ তাহলীল ও মোরাকাবা মোশাহাদায় সোবহে সাদেক হয়ে গেল এমতাবস্থায় গায়ব হতে আওয়াজ ধ্বনিত হলো ‘জাহাঙ্গীর’ ‘জাহাঙ্গীর’ এ আওয়াজ শুনে তিনি বলে উঠলেন, আলহামদুলিল্লাহ! প্রিয় বৎস আশরাফ, এ উপাধীতে ভ‚ষিত হলো। সেই থেকে তাঁর নামের সাথে জাহাঙ্গীর শব্দ সংযুক্ত হলো। শুধু তাই নয় রমজান মাসের সাতাশ তারিখ ক্বদরের রাতে হযরত আলাউল হক পান্ডুবী তাঁকে মারেফতের গুঢ় রহস্যাদি সম্পর্কেও পরিপূর্ণ জ্ঞান প্রদান করেন। এ অবস্থায় হযরত তাঁকে বললেন “বৎস কথায় বলে যে, এক বনে দুটি বাঘ বাস করে না এবং এক খাপে দুটি তলোয়ার থাকতে পারে না। তাই আমি তোমার জন্য এমন একটি স্থান নির্বাচিত করতে চাই যেখানে তুমি আপন কর্মতৎপরতা শুরু করবে এবং তোমার দয়ায় লোকজন উপকৃত হবে। আল্লাহর অগণিত বান্দা তোমার দ্বারা হেদায়ত লাভে ধন্য হবে।” জবাবে হযরত আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানী বলতে লাগলেন, যাঁর সান্নিধ্যের জন্য সিংহাসন ত্যাগ করে, আত্মীয়-পরিজন বন্ধু-বান্ধব সবকিছু ছেড়ে অশেষ কষ্ট করে পরিশ্রম করেছি,যাঁর সাহচার্য লাভের জন্য অবর্ণনীয় ত্যাগ স্বীকার করেছি এবং যাঁর ছায়াতলে জীবন কাটানোর অদম্য বাসনায় আমার জীবন মন ও সর্বস্ব সঁপে দিয়েছি আজ সে ছায়া হতে বঞ্চিত হয়ে বিরহের অসহ্য যাতনা নিয়ে নির্বাসনসম এ ব্যবস্থা আমি কিভাবে গ্রহন করতে পারি? বস্তুত মুর্শীদের সাথে বিচ্ছেদ ভাবনা তাঁকে কাবু করে ফেলে। তাঁর মনের এ অস্থিরতা দেখে পীর ও মুর্শীদ তাকে সান্ত¡তা দিয়ে এরশাদ করলেন “বৎস এটা বিচ্ছেদ নয় বরং এতে আল্লাহর ইচ্ছার প্রতিফলন হয়েছে”। আরো দুই বছর অতিক্রান্ত হলো। অতঃপর হযরত আলাউল হক পান্ডুবী তাঁকে লক্ষ করে বললেন,“ তোমাকে বিদায় করার সিদ্ধান্তের মধ্যে কিছু রহস্য আছে, যা তুমি জাননা। তুমি বরঞ্চ এতে সম্মত হও”
হযরত আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানী স্বীয় মুর্শীদের এ কথার উপর দ্বিমত করা সঙ্গত মনে করলেন না। অনিচ্ছা সত্তে¡ও নিরূপায় হয়ে তিনি মুর্শীদের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে সম্মত হলেন। জৌনপূরে যাওয়া স্থির হলো। দীর্ঘ সাড়ে ছয় বছর কাল পর পীর ও মুর্শীদ হতে বি”্ছন্নি হয়ে তিনি ৭৪২ হিজরী সনে ঈদের দিন জৌনপুর অভিমুখে রওয়ানা হন। জৌনাপুরে তখন বিখ্যাত সাধক শেখ হাজী সদরুদ্দীন চেরাগে হিন্দ সোহরাওয়ার্দী বাস করছিলেন। পীর ও মুর্শিদের কাছে হযরত সৈয়দ আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানী তাঁর দিকে ইঙ্গিত দিয়ে বাঘের নিবাস হিসেবে জৌনপুরকে আখ্যা দিলে পীর সাহেব জবাব দিয়েছিলেন,‘না’ ভয়ের কিছু নাই। তাঁকে বাঘ নয় বাঘের শাবক হিসেবেই পাবে সে নিজেই তোমাকে বাঘ হিসেবে বুঝে শুনে চলবে। রাজকীয় বিদায় দেন পীর ও মুর্শীদ হযরত আশরাফ জাহাাঙ্গীর সিমনানী কে। যাত্রা পথে ‘আরল’ নামক স্থানে অবস্থান করেন অতপর আজমগড় জেলার মোহাম্মদাবাদ পৌছেন এবং বসতির বাইরে এক বাগানে তাবু গেড়ে অবস্থান করতে লাগলেন। জৌনপুরের কাছাকাছি জাফরাবাদে বেশ কিছুদিন অবস্থান করেন। এলাকার আলেম ওলানা ওনার কাছে আসতে থাকে এবং শরিয়ত ও ত্বরিকতের বিভিন্ন বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা হয়, মতভেদ হয় এবং পরবর্তীতে সকল ধরনের সমস্যার সমাধান হয়। হযরতের প্রতি সকল মানুষের ভক্তি শ্রদ্ধা ও ভালবাসা বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং বিভিন্ন কারামত প্রকাশ পেতে থাকে।
প্রিয পাঠক,হযরত আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানী (রাঃ)‘র সফরের বর্ণনা বিশাল এবং বিস্তৃত। আরব ও আজমের পূণ্যভুমিতে ভ্রমণ করে পূণরায় পীরের দরবারে আসেন প্রায় তিন থেকে চার বছর মুর্শীদের দরবারে অবস্থান করে বিদায় নেন। বিদায় কালে মুর্শীদ তাঁকে আধ্যাত্মিক দৃষ্টি দ্বারা স্বীয় কর্মস্থল নির্দেশ করেন। হযরত আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানী বলেন, সেটি একটি গোলাকার পুস্করিনী হিসেবে আমার বাতেনী কাশফের চোখে দৃশ্যমান হয়, তার মধ্যবর্তী স্থানে এক্িট তিলের ন্যায় ফোটা রয়েছে যেটি তিলের মতো দেখতে সেটি হলো একটি টিলা। হযরত আলাউল হক পান্ডুবী বললেন, এটিই তোমার গন্তব্য স্থান। হযরত বেনারস হতে জৌনপুর গমন করেন। জৌনপুর হতে আসলেন কিরমীনি নামক স্থানে তিন চার দিন অবস্থান করেন সেখান হতে ৪ মাইল দুরে অবস্থিত ভডবন্ড বা ভদড় বর্তমান কাছওয়াছা শরীফ নামক স্থানে তশরীফ আনেন। এখানকার শাসক মাহমুদ এবং তার পুত্রগণসহ বহুলোক হযরতের হাতে বাইয়াত গ্রহন করেন। এবং হযরতের সাহায্যে এগিয়ে আসেন । উল্লখ্য, এ স্থান হযরতের কাছে অত্যন্ত পছন্দ হলো। তাঁর মুর্শীদের নির্দেশিত স্থান হিসেবে তিনি এটিকে নির্দিষ্ট করলেন এবং এখানে থাকতে চাইলেন। জানা গেল, এখানকার সবচাইতে আকর্ষণীয় স্থান বলতে একটি গোলাকৃতির পুস্করিনীর পাড় দরপণ নামক জনৈক তান্ত্রিক সাধু দখল করে রেখেছে। তিনি মাহমুদকে সাথে নিয়ে সে স্থানটি দেখতে গেলেন এবং দেখে বললেন “ এটিই আমার স্থান হবে, যার কথা আমার পীর সাহেব আমাকে বলেছিলেন। বেদ্বীনদের উচ্ছেদ করা কঠিন কিছু নয়”। অত:পর তিনি একজন খাদেমকে দিয়ে তান্ত্রিক সাধুকে ঐ স্থান ত্যাগের নির্দেশ দিলেন। কিন্তু সাধু উত্তরে বললো,“ আমার পক্ষে স্থান ত্যাগ সম্ভব নয়। আমার সাথে পাঁচ শতাধিক তান্ত্রিক চেলা (শিষ্য) রয়েছে। কেউ যদি তার বেলায়তের শক্তিতে সকলকে বিতাড়িত করতে সক্ষম হন তবে আমি স্থান ত্যাগ করব।”
এ কথা শুনে হযরত সৈয়দ আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানী সদ্য বাইয়াত গ্রহনকারী মুরীদ জামালউদ্দিনকে ডেকে বললেন “যাও, সে যত রকম যাদু প্রদর্শন করুক না কেন সব গুড়িয়ে দাও এবং প্রয়োজনে যে কোন কারামত প্রদর্শনের জন্য তোমাকে ক্ষমতা দেয়া হল।” তিনি হযরতের কাছ হতে এ ক্ষমতা ও সাহস নিয়ে এগিয়ে গেলেন দৃঢ় পদক্ষেপে। তান্ত্রিক একে একে সব শক্তি প্রদর্শন করতে থাকল, কিন্তু সব কিছু তৃণের মত ভেসে গেল। তান্ত্রিক প্রথমে পিঁপড়া ছাড়ল। হযরত জামাল উদ্দিন দৃষ্টিবান নিক্ষেপ মাত্র সব গায়েব। তারপর সে বাঘের পাল নিয়ে আক্রমণে উদ্যত হলো, সে গুলোও ব্যর্থ হলো। শেষে সে স্বীয় বল্লমকে বাতাসে উড়াতে লাগল। হযরত জামালউদ্দিন হযরতের লাঠি মোবারক আনিয়ে সেটাকে বাতাসের দিকে ছেড়ে দিলেন। হযরতের লাঠি তান্ত্রিকের বল্লমটিকে মাটিতে নামিয়ে আনল। এভাবে তান্ত্রিক তার সব ক্ষমতা প্রয়োগ করে ব্যর্থ হয়ে গেল। সে হযরতের কারামত দেখে হযরতের কদমে নিজেকে সোপর্দ করল এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে হযরতের কদমে উৎসর্গীত হলো। তার পাঁচশত শিষ্য তওবা করে ইসলাম গ্রহন করল। এ স্থানের নামকরণ করা হয় ‘রূহ আবাদ’। এ স্থানে নির্মিত হলো একটি খানেকা এবং হুজরা। পরবর্তীতে হযরত এখানেই থেকেছিলেন এবং ওনার মাজার শরীফ এখানে অবস্থিত। হযরত আবদুর রাজ্জাক নুরুল আইন (রাঃ)‘র মাজার শরীফও একই স্থানে। এটি বর্তমান ভারতের উত্তর প্রদেশস্থ ফয়েজাবাদ জেলায় অবস্থিত। আকবরপুর রেল ষ্টেশনের নিকটবর্তী বিশাখারী ও কাছওয়াছার মধ্যবর্তী পুরো এলাকাটা হেদায়তের কেন্দ্র হিসেবে বিদ্যমান।
চিশতীয়া তরিকায় আউহাদুদ্দীন মীর সৈয়দ আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানী (রাঃ)‘র আধ্যাত্মিক ধারা
১) রহমতুল্লিল আলামিন হযরত মোহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম
২) ইমামুল আউলিয়া হযরত আলী মুশকিল কোশা কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু
৩) হযরত শায়েখ হাসান বসরী (রাঃ)
৪) হযরত শায়েখ আব্দূল ওয়াহিদ বিন জায়েদ (রাঃ)
৫) হযরত শায়েখ সুলতান ইব্রাহিম আদহাম বলখী (রাঃ)
৬) হযরত শায়েখ সৈয়দ ইয়াদুদ্দীন হুজাইফা আল মারাশী(রাঃ)
৭) হযরত শায়েখ আমিনুদ্দীন আবু হুবাইরা বসরী (রাঃ)
৮) হযরত শায়েখ মুমশাদ দিনাওয়ারী (রাঃ)
৯) হযরত শায়েখ খাজা আবু ইসহাক শামী (রাঃ)
১০) হযরত শায়েখ আবু আহমদ আবদাল চিশতী (রাঃ)
১১) হযরত শায়েখ আবু মোহাম্মদ চিশতী (রাঃ)
১২) হযরত শায়েখ নাছির উদ্দীন আবু ইউছুপ বিন সামান (রাঃ)
১৩) হযরত শায়েখ কুতুব উদ্দীন মওদুদ চিশতী (রাঃ)
১৪) হযরত শায়েখ খাজা শরীফ জানদানী (রাঃ)
১৫ হযরত শায়েখ ওসমান হারুনী চিশতী (রাঃ)
১৬) হযরত সুলতানুল মশায়েখ সুলতানুল হিন্দ খাজা মঈন উদ্দীন হাসান সনজরী চিশতী (রাঃ)
১৭) হযরত শায়েখ খাজা কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকী (রাঃ)
১৮) হযরত শায়েখ খাজা বাবা ফরিদ উদ্দীন গঞ্জেশকর(রাঃ)
১৯) হযরত শায়েখ খাজা নিজাম উদ্দিন আউলিয়া মাহবুবে ইলাহী (রাঃ)
২০) হযরত শায়েখ আখি সিরাজুল হক ওয়াদ্দীন ওসমান আইনায়ে হিন্দ (রাঃ)
২১) হযরত শায়েখ আলাউল হক ওয়াদ্দীন গঞ্জেনাবাত পান্ডুবী (রাঃ)
২২) তারেকুচ্ছালতানাত,কুদওয়াতুল কুবরা,মাহবুবে ইয়াজদানী,গাউছুল আলম,মখদুম সোলতান আউহাদুদ্দীন মীর সৈয়দ আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানী (রাঃ)
প্রিয় পাঠক বর্তমানে মুসলিম বিশ্বে আলে রাসুল (সাঃ) ও আওলাদে গাউছে পাকের মাধ্যমে মুসলিম মিল্লাতকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের পথে পরিচালিত করতে এ দরবারের মাশায়েখ গণের ভ‚মিকা অনস্বীকার্য। আধ্যাত্মিকতায় উজ্জিবিত বেলায়তের শক্তি দিয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা ও লিখনীর মাধ্যমে ঈমান আক্বিদা পরিশুদ্ধ রাখার মিশন চলছে আশরাফীয়া সিলসিলার মাধ্যমে। গাউছুল আলম মাহাবুবে ইয়াজদানী সৈয়দ আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানী (রাঃ)‘র মিশন ও ভিশনকে বাস্তবতার মাটি স্পর্শ করাতে মুসলিম বিশে^ ত্বরিকতের খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন কাছওয়াছা দরবার শরীফের বর্তমান সাজ্জাদানসীন আশরাফুল মাশায়েখ আবুল মোখতার সৈয়দ মাহমুদ আশরাফ আল আশরাফী আল জিলানী (মাঃ জিঃ আঃ)। আশরাফীয়া সিলসিলার অন্যান্য আকাবিরগণ নিরলস ত্যাগ ও সাধনা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিভ্রান্ত্রির বেড়াজাল হতে মুসলিম মিল্লাতকে রক্ষার মাধ্যমে ইসলামের মূলধারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের মতাদর্শে পরিচালিত করার মানসে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আঞ্জুমানে আশরাফীয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট। এ সংগঠন আমলে স্বালেহ ও খেদমতে খালকের অনুশীলন করে মুসলিম মিল্লাতকে ইহকালীন শান্তি ও পরকালীর মুক্তির পথে মতে আসার অনুরোধ জানাচ্ছে। শত বৎসরের আশরাফীয়া সিলসিলার অনুসারীদের ঐক্যের মাধ্যমে বাংলাদেশের অসংখ্য নবী প্রেমিক ওলী প্রেমিকের সম্মিলিত প্রয়াসে সুন্নিয়তের সোনালী সময় আসবেই ইনশাল্লাহ।