জাতীয়

২৮ জন নাবিক ভয়ঙ্কর স্মৃতি নিয়ে ফিরলেন।হাদিসুরের মা-বাবা ভাইদের হৃদয়বিদারক হাহাকার

অবশেষে পা পড়ল দেশের মাটিতে। তারা নাবিক। কিন্তু এখন ‘২৮ যোদ্ধা’ যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেন থেকে ফিরে এসেছে।কথা ছিল না উরোজাহাজে ফেরার। কথা ছিল চেনা সাগরের ঢেউ গুনে গুনে দেশে নোঙর করার। তাদের প্রিয় জাহাজ ‘এমভি বেঙ্গলের সমৃদ্ধি’ আলভিয়া বন্দরে রাশিয়ান গোলাবারুদ বোঝাই। এরপর কয়েকদিনের ভয়াবহতার স্মৃতি আঁকিয়ে সবাই যার যার ঘরে ফিরে গেল। কেবল নেই জীবন্ত একজন – হাদিসুর। তাদের ফেরার সঙ্গীও করা যায়নি হাদিসুর নামের কফিনটি ।

যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে ২৮ জন নাবিক প্রত্যক্ষ করেছেন চরকা পোড়ানো, সাগরের ঢেউ রক্তে লাল হয়েছে, বিপন্ন মানুষের আর্তনাদ, প্রিয় সহকর্মীর নির্মম মৃত্যু। তাদের মুখ থেকে রুশ হামলার বর্বরতার গল্প শুনতে চান গণমাধ্যমকর্মীরা। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভিআইপি টার্মিনালের সামনে তাই গণমাধ্যমকর্মীদের উপচেপড়া ভিড়। গতকাল দুপুরে মানুষের মধ্যে দুশ্চিন্তা আর নিষ্ঠুরতার স্মৃতি নিয়ে ক্লান্ত ২৮ জন নাবিককে অতিক্রম করতে হিমশিম খেতে হয়েছে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা কর্মীদের। তবে সাংবাদিকদের তথ্যের তৃষ্ণা মেটাতে ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসেন এক ব্যক্তি। তিনি জাহাজের ক্যাপ্টেন জিএম নূরে আলম।

ক্লান্ত হয়ে প্রথমে বললেন, ‘আমার প্রিয় সহকর্মী হাদিসুর রহমানের মরদেহ হিমাগারে রেখে এসেছি। সেই বিষাদ বুকে চেপে আছে। আশা করছি, খুব শিগগিরই তার মরদেহ দেশে আনা হবে। তাদের সুস্বাস্থ্যে দেশে ফিরিয়ে আনতে সম্ভাব্য সব উদ্যোগ নেওয়ার জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

তিনি বলেন অনেক দেশের জাহাজ এবং তাদের নাবিক এবং ক্রু এখনও আলভিয়া বন্দরে আটকা পড়েছে। হামলার ভয়াবহতার মধ্যেও তারা বাংকারে দুশ্চিন্তা ও অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছেন। এ কারণে নিজেদের উদ্ধারের ঘটনা তাদের কাছে অনেক বড়।

নূরে আলম জানান, হামলার দিন বিকেলে তারা ডিউটিতে ছিলেন। অতর্কিত হামলায় জাহাজে আগুন ধরে যায়। সেই অবস্থায় তাদের প্রথম চেষ্টা ছিল আগুন নেভানোর। খুব অল্প সময়ের মধ্যে তারা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। দায়িত্বরত তৃতীয় প্রকৌশলী হাদিসুরের দেহ নিথর হয়ে পড়েছিল। তারা দ্রুত তাদের প্রিয় সহকর্মীর লাশ নিয়ে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেন। অল্প সময়ের মধ্যে, আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা সহ বেশ কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মীদের দ্বারা তাদের সাথে যোগাযোগ করা হয়। এক দিনের মধ্যে, পোল্যান্ডে তাদের প্রথম স্থানান্তর শুরু হয়। যাইহোক, পোল্যান্ড সীমান্ত নিরাপদ না হওয়ায় তাদের রুট রোমানিয়ার সীমান্তে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়।

নূরে আলম আরও জানান, সীমান্তের কাছে যাওয়ার সময় তারা ৬০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত দিয়ে শত শত লোককে হাঁটতে দেখেন। তবে আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার উদ্যোগে তাদের পায়ে হেঁটে সীমান্ত পাড়ি দিতে হয়নি।

কেন এবং কীভাবে ‘এমভি বাংলা সমৃদ্ধি’ আলভিয়া বন্দরে আটকে গেল জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাদের জাহাজটি ২২ ফেব্রুয়ারি আলভিয়া বন্দরে নোঙর করে। সেখান থেকে সিমেন্টের মাটি নিয়ে ২৪ ফেব্রুয়ারি ইতালীয় বন্দর রাভেনার উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার কথা ছিল। জাহাজ ছাড়ার দিনে যখন রাশিয়ান আক্রমণ শুরু হয়, তখন বন্দর থেকে বেরিয়ে আসা সমস্ত চ্যানেল বন্ধ করে দেওয়া হয়। শুধু তাদের জাহাজ নয়, একই বন্দরে আটকা পড়েছে আরও অনেক জাহাজ। ২৪ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকে এ বন্দর ছাড়ার কোনো সুযোগ ছিল না। তিনি এখানে আটকে থাকা অবস্থায় ২ মার্চ বিকেলে হামলার ঘটনা ঘটে। ২৮ জন নাবিক বাংলাদেশ সময় ৫ মার্চ দুপুরে ইউক্রেনের আলভিয়া বন্দর সংলগ্ন বাঙ্কার ত্যাগ করেন এবং একটি আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মীদের তত্ত্বাবধানে ইউক্রেন থেকে প্রতিবেশী মলদোভায় রওনা হন। পরের দিন সকালে, ৭ মার্চ, তারা মোল্দোভায় পৌঁছায়। একই দিন দুপুরে তিনি রোমানিয়ায় পৌঁছান। এরপর বাংলাদেশ সময় মঙ্গলবার দিবাগত রাত ২টা ১৫ মিনিটে তারা তুর্কি এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে দেশের উদ্দেশে যাত্রা করেন।

বিমানবন্দরে আরেক নাবিকের সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, হামলার পর দুই দিন কেটে গেছে, এমন একটি অভিজ্ঞতা যা কখনো ভোলার নয়। এমন পরিস্থিতি কারো জীবনে যেন না আসে।

নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত তালিকা অনুযায়ী ক্যাপ্টেন নূর আলম ছাড়া আরও ২৮ জন নাবিক দেশে ফিরেছেন- মোঃ মনসুরুল ইসলাম খান, সেলিম মিয়া, রামকৃষ্ণ বিশ্বাস, মোঃ রোকনুজ্জামান রাজীব, ফারিয়াতুল জান্নাত তুলি, ফয়সাল আহমেদ সেতু, মো. ওমর ফারুক, সৈয়দ আশিফুল ইসলাম, রাজিবুল আউয়াল, সালমান সরওয়ার সামি, ফারজানা ইসলাম মৌ, শেখ সাদী, মাসুদুর রহমান, জামাল হোসেন, মোহাম্মদ হানিফ, আমিনুর ইসলাম, মহিন উদ্দিন, হোসেন মোহাম্মদ রকিব, সাজ্জাদ ইবনে আলম, নজরুল ইসলাম, নাজমুল উদ্দিন, মো. , সারোয়ার হোসেন, মাসুম বিল্লাহ, মোহাম্মদ হোসেন, আতিকুর রহমান, শফিকুর রহমান ও মোহাম্মদ সাইফ উদ্দিন।

বিমানবন্দরের ভিআইপি গেটে নিহত নাবিক হাদিসুর আবদুর রাজ্জাক হাওলাদার ও মা রাশিদা বেগমের বাবা-মা উপস্থিত ছিলেন। তার সঙ্গে ছিলেন তার দুই ছেলে তরিকুল ও গোলাম মাওলা।

মন্তব্য করুন