হুন্ডি সন্দেহে ২০০ এমএফএস হিসাব ফ্রিজ
ভবিষ্যতে অবৈধর মাধ্যমে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ বাজেয়াপ্ত করা হবে
মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট-বিএফআইইউ ডিজিটাল হুন্ডি ঠেকাতে ভিন্ন কৌশল নিচ্ছে। ডিলার এবং এজেন্সি বাতিল, সিআইডি-তে তথ্য পাঠানোর পরে, কিছু সুবিধাভোগী এমএফএস অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স পেয়েছে বলে সন্দেহ করা ২৩০টি এমএফএস অ্যাকাউন্ট গতকাল প্রথমবারের মতো বিএফআইউ দ্বারা হিমায়িত করা হয়েছে। অ্যাকাউন্ট জব্দ করার পাশাপাশি পরবর্তী আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। হুন্ডি প্রতিরোধে সরকারের উচ্চপর্যায়ে আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, এ ধরনের লেনদেন শনাক্ত করতে বিএফআইইউ সব ব্যাংক ও এমএফএস প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে। ২৩০টি অ্যাকাউন্ট পুনরায় সক্রিয় করা হবে এই শর্তে যে তারা ভবিষ্যতে অবৈধ চ্যানেলের মাধ্যমে অর্থ পাঠাবে না। এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো হবে। এরপরও হুন্ডি প্রমাণিত হলে পুরো অর্থ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত হবে। একই সঙ্গে সুবিধাভোগীর বিরুদ্ধে মামলাসহ বিভিন্ন আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
বিএফআইইউ এর আগে লক্ষাধিক এজেন্টের তথ্য বিশ্লেষণ করে হুন্ডিতে জড়িত সন্দেহের জন্য সারা দেশে ৫,৪১৯ এমএফএসকে চিহ্নিত করেছিল। এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলি এই সংস্থাগুলি বাতিল করে। পরে এই তালিকা বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) দেওয়া হয়। এর ভিত্তিতে সিআইডি ইতিমধ্যে ৫টি মামলা নথিভুক্ত করেছে। এ ছাড়া কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। সংস্থাটি সেই তালিকার ভিত্তিতে আরও যাচাই-বাছাই এবং ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
বিএফআইইউর তথ্য অনুযায়ী, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রবাসীদের কাছ থেকে অবৈধভাবে অর্থ সংগ্রহ করে একটি চক্র।
এরপর বিকাশ, নগদ, প্রবাসী সুবিধাভোগীর রকেট সহ বিভিন্ন এমএফএস নম্বর এখানে এজেন্টকে দেওয়া হয়। এজেন্ট তারপর নির্দিষ্ট পরিমাণ তাৎক্ষণিকভাবে সুবিধাভোগীর নম্বরে স্থানান্তর করে। এভাবে টাকা এলে বৈদেশিক মুদ্রা বাইরে থেকে যায়। দেশের বাইরে সংগৃহীত অর্থ তখন চড়া দামে কিনে নেয় অর্থ পাচারকারীরা।
গত রোববার ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এমডিদের বৈঠকে গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে বলেন, প্রতি কেজি ১২ টাকা দরে কমলা রঙের এলসি খোলা হয়েছে। আপেল প্রতি কেজি ১৮ টাকা, খেজুরের এলসি হয়েছে ২০ টাকা। মার্সিডিজ বেঞ্জ আনা হচ্ছে ২০ লাখ টাকা দামে। কর ফাঁকি দিতে চালানের অধীনে পণ্য আমদানি করা (দাম কম দেখানো)। বাকি টাকা দেওয়া হচ্ছে মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে। ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করা হচ্ছে। এ ধরনের কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে তিনি কঠোর হুঁশিয়ারি দেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে টাকা আনা আইনত অপরাধ। কিন্তু প্রবাসীদের একটি অংশ সুবিধাভোগীর কাছে টাকা পৌঁছানোর সহজ উপায় হিসেবে হুন্ডি বেছে নেয়। এ কারণে শ্রমিকরা বিদেশ গেলেও রেমিটেন্স কমছে। কিন্তু এক বছর আগের তুলনায় এখন ব্যাঙ্কিং চ্যানেলে টাকা পাঠিয়ে প্রতি ডলারে ২২ টাকা বেশি পাচ্ছেন। চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে গড়ে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স এসেছে। তবে সেপ্টেম্বরে তা কমে দাঁড়ায় ১.৫৪ বিলিয়ন ডলারে। অক্টোবরে এটি আরও কমে বৈদেশিক মুদ্রা সংকটের এ সময়ে প্রবাসী আয় কমে যাওয়ায় চাপ বাড়ছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে।
রেমিটেন্স কমে যাওয়া এবং বৈশ্বিক বাজারে বেশির ভাগ পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানি দায় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে বেশিরভাগ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক গতকাল পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে ৫৮৭ মিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে। গত অর্থবছরে বিক্রি হয়েছে ৭৬২ মিলিয়ন ১৭ মিলিয়ন ডলার। ডলার বিক্রির ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমাগত কমছে। গতকাল দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৪ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। গত বছরের আগস্টে যেখানে রিজার্ভ ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলারের ওপরে। তবে আইএমএফের মান অনুযায়ী দেশের রিজার্ভ এখন ২৫ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন ডলার। এ বাস্তবতায় সরকার আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকাসহ বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার চেষ্টা করছে।
হুন্ডি প্রতিরোধে বাংলাদেশ ব্যাংকের হুঁশিয়ারি : হুন্ডির বিরুদ্ধে সচেতনতা বাড়াতে গতকাল এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সতর্ক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে বলা হয়েছে, প্রবাসী বাংলাদেশি এবং তাদের প্রিয়জনদের জানানো হচ্ছে যে, ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে (হুন্ডি বা অন্য কোনো অবৈধ পথে) কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পাঠানো একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এতে দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের বলেছে, ‘দেশের বাইরে অর্জিত মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা হুন্ডি বা অন্য কোনো মাধ্যমে না পাঠিয়ে ব্যাংকিং মাধ্যমে পাঠান। জাতি গঠনে মূল্যবান অবদান রাখুন।