হাটে দামের চাপে ক্রেতা, অস্বস্তিতে খামারি
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাচিলার হাটে ১৫টি দেশি গরু তুলেছেন পটুয়াখালীর কলাপাড়ার ব্যবসায়ী আজিজুর রহমান। তিনি সাফ জানিয়ে দেন, সব ধরনের পশুখাদ্যের দাম বেড়েছে, গাড়ি ভাড়া বেড়েছে। এবার এক লাখের নিচে গরু বিক্রি করবেন না। একই হাটে ছোট-বড় ৫৫টি গরু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন কুষ্টিয়ার রহমত উল্যাহ। তার মতে, ক্রেতারা চরম টেনশনে আছেন বলে মনে হচ্ছে। অনেকেই হাটে সবচেয়ে ছোট ও দামি গরু খুঁজছেন। এদিকে নাটোরের কৃষক মোসলেম উদ্দিন গাবতলী হাটে ১১টি বড় গরু নিয়ে এসেছেন। ঢাকায় গরু আনতে গিয়ে তিনি হতাশ বলে জানান। হাট সব ধরনের পশুতে ভরপুর, কিন্তু ক্রেতা নেই। মানুষের আর্থিক অবস্থা খারাপ। যে কয়জন ক্রেতা আসছেন, তাদের চোখ ছোট গরুর দিকে।
ঢাকার বাইরে থেকে পশু নিয়ে আসা এসব খামারি ও ব্যবসায়ীদের হাপিত্যেশ বলছেন, এবার ব্যবসা নিয়ে বেশ অস্বস্তিতে আছেন তারা। একটি উচ্চ-মূল্যের বাজারে, চঞ্চল ক্রেতারাও ভাল করছে না। রাজধানীতে প্রবেশ করছে কোরবানির পশুর ট্রাক। তবে বাজারে তেমন ক্রেতা না থাকায় বেচা-কেনা এখনো জমে ওঠেনি।
এবার ছোট গরুর চাহিদা বেশি। ছোট, মাঝারি বা বড় – আকার যাই হোক না কেন, সব ধরনের গরুর দাম বেশি। এমতাবস্থায় অর্থনৈতিক মন্দায় পরিবার চালাতে সংগ্রামরত মধ্যবিত্তের একটি বড় অংশ ত্যাগ স্বীকারের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। ফলে এ বছর কোরবানির জন্য প্রস্তুত বিপুলসংখ্যক গরু-ছাগল অবিক্রীত থেকে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর বিগত কয়েক বছরের মতো এবারও অবিক্রীত পশু নিয়ে বিপাকে পড়তে পারেন খামারি ও ব্যবসায়ীরা। এদিকে বর্ষার আগেই গবাদিপশুতে দেখা দিয়েছে লম্পি চর্মরোগ (এলএসডি)। কোরবানির ঈদের আগে এ ধরনের ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় কৃষকরা দুশ্চিন্তায় পড়েছেন।
সব মিলিয়ে কোরবানির ঈদের আগে ক্রেতাদের অস্বস্তি; দাম কত হবে এবং কতটা লাভ হবে তা নিয়েও চিন্তিত বিক্রেতারা। তবে এবার জাতীয় নির্বাচনের বছর হওয়ায় অন্যান্য সময়ের তুলনায় পশু বেচাকেনা একটু বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
মজুদ বেশি, দামও বেশি
প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর কোরবানির জন্য মোট গরুর সংখ্যা ১ কোটি ২৫ লাখ ৩৬ হাজার ৩৩৩টি, যা গত বছরের চেয়ে ৪ লাখ ১১ হাজার ৯৪৪টি বেশি। এ বছর কোরবানির পশুর সম্ভাব্য চাহিদা ১ কোটি ৩ লাখ ৯৪ হাজার ৭৩৯ টাকা। সে অনুযায়ী এ বছর কোরবানির পরও দেশে ২১ লাখ ৪১ হাজার ৫৯৪টি পশু থাকবে। এত মজুদ থাকা সত্ত্বেও কোরবানির পশুর দাম যে একটু বাড়বে তা ইতিমধ্যেই স্পষ্ট।
রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ও খামার ঘুরে দেখা গেছে, বেড়েছে পশুর দাম। মোহাম্মদপুরের সাদিক এগ্রোতে গভীর রাত পর্যন্ত ক্রেতাদের ভিড়। দেদারে বিক্রি হচ্ছে গরু, উট, দুম্বা, গোলাপি মহিষ, ভেড়া ও খাসি। এখানে ঈদ উপলক্ষে আকর্ষণীয় গরুর সংগ্রহ রয়েছে। ১ লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকা মূল্যের পশু পাওয়া যায়। প্রস্তুত করা সাড়ে আট হাজার পশুর ৭০ শতাংশ বিক্রি হয়েছে। সাদিক এগ্রোর কর্মকর্তা শাহ ইমরান জানান, গত বছর গরুর দাম ছিল ৭০ হাজার টাকা, এবার বিক্রি হচ্ছে ১ লাখ টাকায়। গতবার লাইভ ওয়েটের দাম প্রতি কেজি ৪৬০ টাকা থেকে বেড়ে ৪৭৫ টাকা হয়েছে। এবার তা বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৫শ টাকায়। আমাদের খামারে উৎপাদন খরচ বেড়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। ছোট গরুর চাহিদা বেশি থাকায় এবার দামও বেশি। তবে বড় আকারের গরুর দাম একই থাকতে পারে।
দেখা গেছে, তিন মণ মাংস পাওয়া গরুর দাম ৯৬ হাজার টাকা থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত। আর চার মণ মাংস মেটাতে পারে এমন মাঝারি আকারের দেশি গরুর দাম চাওয়া হচ্ছে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা। ফলে তিন মণ ওজনের গরুর দাম গত বছরের তুলনায় ২৪-৩০ হাজার টাকা বেশি বলে দেখা গেছে।
ব্যবসায়ীদের যুক্তি, কোরবানির পশুর দাম নির্ভর করে মাংসের দামের ওপর। গত বছর গরুর মাংস বিক্রি হয়েছিল ৬০০ টাকা কেজি। সেই মাংসের দাম এক বছরের মধ্যে বেড়েছে ৭৫০ টাকা। সে হিসাবে মাংসের দাম বেড়েছে ছয় হাজার টাকা। এ কারণে তিন মণ ওজনের একটি গরুর দাম বেড়েছে ১৮ হাজার টাকা।
একটি বেসরকারি কোম্পানিতে কর্মরত আরিফুর রহমান স্ত্রী-সন্তান নিয়ে গাবতলী বাজারে আসেন। তিনি বেশ কয়েকটি গরু পছন্দ করেছেন। তবে দাম বেশি হওয়ায় কিনতে পারেননি তিনি। আরিফ জানান, তিন ভাই মিলে তারা গরু কিনেছেন। গতবার তিনি ৯৭ হাজার টাকায় একটি মাঝারি আকারের গরু কিনেছিলেন। একই জাতের গরুর জন্য দেড় থেকে দুই লাখ টাকা ভাড়া নিচ্ছেন ডিলাররা।
মোহাম্মদপুরের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আহসান উল্লাহ বলেন, কয়েক বছরের জন্য ১০ হাজার টাকার একটি অংশ দিতে পারলেও এ বছর তা সম্ভব হবে কিনা জানি না।