বিবিধ

সেন্টমার্টিনে মোকার দাগ

সেন্টমার্টিনের কোণে মরিয়ম খাতুনের ছোট্ট বাড়িটি এখন ভাঙ্গা । বাঁশের ওপর কালো পলিথিনের চাদর দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে শেডটি। ঝড়ে দুই কক্ষের বাড়ির মূল অংশ পুরোপুরি উড়ে গেছে। বাড়িতে চার সন্তান। সঙ্গে দিনমজুর স্বামী। ছোট্ট রান্নাঘরে ছয়জনের এখন ব্যস্ত জীবন। দুঃখের কথা বলতে বলতে চোখে পানি চলে এলো। মরিয়ম বলেন, ক্ষেতে নোনা পানি প্রবেশ করায় এ বছর আমরা মরিচের ক্ষেত ঠিকমতো করতে পারিনি, এখন ভাঙা বসার ঘর চলে গেছে।

‘দুর্বল’ মোকা প্রবাল সেন্ট মার্টিন দ্বীপে দাগ রেখে গেছে। সোমবার সেন্টমার্টিনের বেশ কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, অনেক ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। কয়েকটি বাড়ির চাল উড়ে গেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মাদ্রাসা ধ্বংস হয়েছে। সেন্ট মার্টিন জুড়ে গাছপালার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

ঘূর্ণিঝড়ের পর থেকে সেন্টমার্টিন একটি ভুতুড়ে শহর। বিদ্যুৎ নেই. নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রেরও অভাব রয়েছে। টেকনাফের সঙ্গে সেন্টমার্টিনের যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বাভাবিক না থাকায় প্রতিদিনের খাবার ঠিকমতো দ্বীপে আসছে না।

কোনাপাড়ার মরিয়ম জানান, ঘূর্ণিঝড় শুরু হওয়ার আগের দিন তারা একটি হাসপাতালে আশ্রয় নিয়েছিলেন। হাসপাতালটিকে আশ্রয় কেন্দ্র ঘোষণা করা হয়। ঘূর্ণিঝড়ের সময় তিনি তার চার সন্তান ও স্বামীকে নিয়ে ওই আশ্রয়কেন্দ্রে ছিলেন। ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে তিনি ভয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। ইতিমধ্যেই তার হার্টের সমস্যা রয়েছে। পরে জানতে পেরে আশ্রয় চিকিৎসক এসে চিকিৎসা করেন।

উত্তরপাড়ায়ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। হাছিনা বেগম ওই পাড়ার বাসিন্দা। তার বাড়ি গুচ্ছগ্রামের মতো এলাকায়। আশেপাশে আরও ১৪টি বাড়ি। প্রতিটি ঘর আংশিক বা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। হাসিনার বাড়ির সামনে একটি বড় আম গাছ উপড়ে পড়েছে। হাসিনার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তার সংসারে দুই ছেলে হামিদুল ও ইসমাইল এবং স্বামী মামুনুর রয়েছে। স্বামী জেলে।

বেশিরভাগ সময় তিনি সমুদ্রে ট্রলারে থাকেন। ঘূর্ণিঝড়ের দুই দিন আগে থেকে স্বামীকে দেখতে পাননি তিনি। বাড়ি ছাড়ার আগে তিনি শুধু বলেছিলেন ঘূর্ণিঝড়ের সময় টেকনাফেই থাকবেন। স্ত্রী-সন্তানদের ছেড়ে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে হাছিনা বলেন, স্ত্রী-সন্তানদের জন্য খারাপ লাগে না কার! সোমবার তিনি মুঠোফোনে জানান, তিনি ভালো আছেন।

ওই এলাকার বাসিন্দা আবদুল হামিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অনেকেই বাড়িঘর ছেড়ে সেন্টমার্টিন ছেড়ে যেতে চান না। ঝড় আঘাত হানার আগেই সবাই আশ্রয়কেন্দ্রে চলে যায়। হামিদ বলেন, অনেকেই বলেছিল এই ঘূর্ণিঝড়ে পানি বাড়বে। কেউ কেউ টাকা ও খাবার মাটির নিচে ফেলে আশ্রয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত পানি বাড়েনি। কিন্তু ঝড়ের প্রকোপ অনেক দিন পর দেখা গেল সেন্ট মার্টিনে। তিনি তার জীবন বাঁচানোর জন্য উর্ধ্বতনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।

সরেজমিনে দেখা গেছে, অসংখ্য গাছ ভেঙে পড়েছে। প্রায় প্রতিটি বাড়ির সামনে থেকে উপড়ে পড়া গাছ সরানোর চেষ্টা করছেন বাসিন্দারা।

কোনারপাড়ায় হাসানের বাড়ির দৃশ্যটা একেবারেই আলাদা। গতকাল দুপুরে শারীরিক প্রতিবন্ধী হাসান বাড়ির সামনে একটি প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে ছিলেন। তার দুই ছেলে ও তিন মেয়ে। এতে হাসানের বাড়ির একটি অংশ সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়। আরেক অংশের সামনে একটা বড় আম গাছ পড়ে আছে। গাছটি সরিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত তিনি ঘরে ঢুকতে পারেননি। তার পুরো ঘরই ছেয়ে গেছে। হাসান বলেন, আমি ১৯৯১ সালের ঝড় দেখেছি। মনে হয়েছিল এই ঝড় সেন্ট মার্টিনকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। প্রতিটি বাড়িতেই কোনো না কোনো ক্ষতি হয়েছে। পূর্বপাড়ার যুবক আবু বকর সিদ্দিক বলেন, ‘এমন বাতাস আগে দেখিনি। আমি ভয়ে আশ্রয়ে মায়ের গলা চেপে ধরেছিলাম।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, সেন্টমার্টিনের অধিকাংশ বাসিন্দার বাড়ির কাঠামো খুবই দুর্বল। তাই কমবেশি প্রতিটি ঘরই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে গাছের। শীঘ্রই এখানে একটি সমন্বিত বৃক্ষরোপণ অভিযান কার্যক্রম শুরু হবে। ক্ষতিগ্রস্তদের মেরামতের জন্য সরকারি টাকা ও টিন কেনা হবে। সোমবার সেন্টমার্টিনে প্রাথমিকভাবে এক হাজার মানুষকে ত্রাণ দেওয়া হয়েছে। ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।