সরেজমিন রূপগঞ্জ।অপরাধীদের সদর দপ্তর চানপাড়া
রূপগঞ্জ থানার কায়েতপাড়া ইউনিয়নের চানপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্র এলাকাটি ‘চনপাড়া বস্তি’ নামে পরিচিত। এই বস্তির জনসংখ্যা ১০ লাখের বেশি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে আরেকটি পরিচয় গড়ে উঠেছে। এটি মাদক ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন অপরাধীর ‘হেডকোয়ার্টার’ বলে জানা গেছে। এখানকার অনেকেই খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, চাঁদাবাজি, অচেতন পার্টিসহ নানা ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত। বস্তিতে খোলামেলা ইয়াবা, হেরোইন, ফেনসিডিল, গাঁজাসহ বিভিন্ন মাদক ব্যবসা হয়।
এখানকার সাধারণ বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে। গত ৪ নভেম্বর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র ফারদিন নূর শেষ ঠিকানা চানপাড়ায় নিশ্চিত হওয়ার পর আবারও আলোচনায় এ জনপদ।
শুক্রবার চনপাড়ায় অন্তত শতাধিক মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি। বৃহস্পতিবার র্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত রাশেদুল ইসলাম শাহীন ওরফে সিটি শাহীনের একটি বড় অপরাধী বাহিনী রয়েছে বলে অধিকাংশই জানিয়েছেন। তিনি ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও চনপাড়া মাদক নির্মূল কমিটির সদস্য সচিব ছিলেন। তার অত্যাচারে এলাকাবাসী অতিষ্ঠ। হামলা-নির্যাতনের ভয়ে শাহীন ও তার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কথা বলার সাহস নেই কারও।
ভয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চাঁনপাড়া বাজার এলাকার এক প্রবীণ ব্যবসায়ী জানান, শাহীন ও তার দল মানুষের বাড়িঘর ভাংচুর করে। বাড়ির দামি আসবাবপত্র থেকে শুরু করে প্রকাশ্যে চুরি হয়েছে নগদ টাকা। অসহায় প্রতিবেশীদের নীরবে এসব দেখা ছাড়া প্রতিবাদ করার কোনো সুযোগ ছিল না।
চানপাড়া বিশাল এলাকা হওয়ায় বস্তি নিয়ন্ত্রণকারীরা একে নয়টি মহল্লায় ভাগ করেছেন। আধিপত্যের ভিত্তিতে পাঁচ-ছয়টি দল রয়েছে। তবে বিভিন্ন সূত্র ও স্থানীয় লোকজন জানায়, বস্তির প্রধান নিয়ন্ত্রক কায়েতপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের ৯নং ওয়ার্ডের (চাঁনপাড়া বস্তি এলাকা) সদস্য ও রূপগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা বজলুর রহমান। সে সব মাদক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে সাপ্তাহিক ও মাসিক টাকা নেয়।
একটি গ্রুপের মালিক জয়নাল আবেদীন বজলুর রহমানের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। সব খারাপ কাজে তাকে ব্যবহার করত। জয়নালের প্রতিপক্ষ ছিলেন শাহীন। ছয়-সাত মাস আগে মাদক ব্যবসা ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে শাহীন ও জয়নাল গ্রুপের মধ্যে মারামারি হয়। এতে শাহিনের পক্ষের একজন নিহত হয়। ওই মামলায় জয়নাল আবেদীন গ্রেফতার হয়ে বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। জয়নাল জেলে যাওয়ার পর শাহীনকে ফোন করেন আওয়ামী লীগ নেতা বজলুর রহমান। এর পর আরও রুদ্রমূর্তি ধারণ করেন শাহীন। বজলুর রহমান সম্প্রতি মাদক মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারাগারে রয়েছেন।
র্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ শাহীনের মৃত্যুর ঘটনায় র্যাব-১ এর সিপিসি-১ এর পুলিশ পরিদর্শক আশরাফুজ্জামান বাদী হয়ে শুক্রবার রূপগঞ্জ থানায় মামলা করেন। অজ্ঞাত মাদক ব্যবসায়ীদের গুলিতে শাহীন নিহত হয়েছেন বলে একটি মামলায় জানা গেছে। মামলায় অজ্ঞাতপরিচয় ৩০-৩৫ জনকে আসামি করা হয়েছে।
পুলিশ পরিদর্শক আশরাফুজ্জামান জানান, চাঁনপাড়া বস্তির তিন নম্বর এলাকার বালুর মাঠে মাদক বিক্রির খবর পেয়ে বৃহস্পতিবার দুপুর ১টার দিকে র্যাব-১ এর একটি দল অভিযানে যায়। র্যাবের উপস্থিতি টের পেয়ে মাদক ব্যবসায়ীরা র্যাবের ওপর গুলি চালায়। র্যাবও পাল্টা গুলি চালায়। এক পর্যায়ে মাদক ব্যবসায়ীরা পালিয়ে যায়। পরে দেখা যায়, শাহীন গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছে। তার পাশ থেকে একটি পিস্তল, তিন রাউন্ড গুলি ও ২০ গ্রাম হেরোইন পাওয়া গেছে। তাকে উদ্ধার করে ঢাকার মুগদা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
র্যাব-১ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবদুল্লাহ মোমেন জানান, শাহীনকে আটক করে নৌকায় নিয়ে যাওয়ার পর সে ডুবিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। এর আগে তার লোকজন র্যাবের ওপর হামলা চালায়। রূপগঞ্জ থানার ওসি এএফএম সৈয়দ জানান, র্যাবের মামলার আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
তবে শাহীনের স্ত্রী রোকেয়া আক্তার ইতির দাবি, বৃহস্পতিবার সকালে তার স্বামী বাড়িতে ঘুমাচ্ছিলেন। সাড়ে ১০টার পর শাহীনের ফোনে একাধিক কল আসে। সে ফোনে কারো সাথে কথা বলে। এরপর বেলা ১১টার দিকে তিনি দুই নম্বর চনপাড়ায় যাওয়ার কথা বলে বাড়ি থেকে বের হন। বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর তিনি গুলির শব্দ শুনতে পান। স্বামী হত্যার বিচার চান তিনি।
ইতির দাবি, তার স্বামী মাদকের বিরুদ্ধে কথা বলতেন। এ কারণে চনপাড়ার মাদক ব্যবসায়ীরা তার ওপর ক্ষুব্ধ। শমসের, শফিকুল, শাহ আলম ও সাহাবুদ্দিন ওই এলাকার অন্যতম মাদক ব্যবসায়ী। তাদের সঙ্গে শাহীনের বিরোধ চলছিল।
জানা যায়, গত সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে চনপাড়া বস্তিতে অভিযান চালিয়ে শাহীনসহ কয়েকজনকে আটক করে র্যাব। এ সময় শাহীন ও তার লোকজন কয়েকজন র্যাব সদস্যকে পিটিয়ে পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় র্যাব-১ এর নায়েক সুবেদার তৌফিকুল ইসলাম বাদী হয়ে রূপগঞ্জ থানায় মামলা করেন। এতে আওয়ামী লীগ নেতা বজলুর রহমানসহ ৩১ জনকে আসামি করা হয়। ওই মামলায় বজলু ও তার ছোট ভাই কারাগারে রয়েছেন।