সরকারি হাসপাতালে প্রাইভেটের ফাঁদ
রাজধানীর কলেজ গেট থেকে শেরেবাংলা নগর হয়ে শ্যামলী পর্যন্ত এটুকু এলাকায় রয়েছে ১০টি বড় সরকারি হাসপাতাল। প্রতিদিন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হাজার হাজার মানুষ সেখানে চিকিৎসা নিতে আসেন। তবে এলাকার আশেপাশে ছোট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার গড়ে উঠেছে। প্রতিদিন অন্তত ৪০টি বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রোগী ভাগিয়ে নিচ্ছে। রোগী ও স্বজনদের পকেট ফাঁকা থাকলেও যথাযথ চিকিৎসা পাওয়া যাচ্ছে না। হাসপাতালগুলোতে যে ধরনের ব্যবস্থাপনা ও যন্ত্রপাতি থাকার কথা তাদের নেই। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে উপযুক্ত চিকিৎসকও অনুপস্থিত। মাঝে মাঝে অপচিকিৎসার কারণে রোগীর অকালে মৃত্যু হয়।
শ্যামলী ও আশপাশের এলাকা যা ‘হাসপাতাল পাড়া’ নামে পরিচিত, পরিদর্শন করা হয় এবং চিকিৎসা সেবা চাওয়ার অনেক দুঃখজনক ঘটনা জানা যায়। সরেজমিনে দেখা গেছে, সরকারি হাসপাতালগুলোকে পুঁজি করে কলেজ গেট, বাবর রোড, খিলজি রোড, হুমায়ুন রোড ও শ্যামলী এলাকায় চিকিৎসার নামে ফাঁদ পাতছে কিছু প্রভাবশালী মহল। প্রতিটি হাসপাতালই ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় রাজনৈতিক নেতার ‘দোকান’।
১১ ফেব্রুয়ারি, বিকাল ৩:১৫ পিএম কলেজ গেট সংলগ্ন মুক্তিযোদ্ধা টাওয়ারের সামনে ফুটপাতে তিনজন দাঁড়িয়ে মরিয়া হয়ে বলছেন- এত টাকা জোগাড় করবেন কী করে! বেসরকারি হাসপাতালে রোগী এনে ভুল করলেন ! কি হয়েছে জানতে চাইলে. জালাল নামে এক ব্যক্তি জানান, তাদের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের কলাগাছিয়ায়। সকাল সাড়ে ১১টার দিকে বাড়িতে বিষ পান করেন তার শ্যালকের স্ত্রী ফাতেমা (২১)। সেখান থেকে রোগীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। তারপর ওয়াশ করানো হয় যারা ওয়াশিং করেছে তারা ধম্মেকে ‘ঢাকা হেলথ কেয়ার হাসপাতালে’ পাঠায় এই বলে যে রোগী রাখা যাবে না। রোগীকে এখানে আনার পর প্রয়োজনীয় টাকা পরিশোধ করতে না পারায় তাকে ভর্তি করেনি কর্তৃপক্ষ।
জালাল বলেন, এত টাকা কোথায় পাব? রোগীর স্বামী রিকশা চালান। পরে যে অ্যাম্বুলেন্সে করে ফাতেমাকে স্বাস্থ্য সেবায় নিয়ে আসেন, সেই অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (মিটফোর্ড) নিয়ে যান স্বজনরা। মিটফোর্ডে নেওয়ার পর চিকিৎসকরা জানান, ফাতেমার মৃত্যু হয়েছে। জালালের মতে, স্বাস্থ্যসেবা হাসপাতাল তাকে চিকিৎসা দিলে ফাতেমার মৃত্যু হতো না।
ফাতেমাকে বিনা চিকিৎসায় ফেরানোর বিষয়ে ঢাকা হেলথ কেয়ার হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আনিসুর রহমান বলেন, ‘আমি সেবা দেওয়ার ব্যবসা করি। তাই এখানে যত রোগী আসেন, তাদের ভালো চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। শুধু খরচ দিলেও আমি চিকিৎসা নিয়ে থাকি। ফাতেমার স্বজনরা রোগী ভর্তির খরচ একেবারেই দিতে পারেননি। এ কারণে তারা রোগীকে নিয়ে যায়। আনিসুর রহমান দাবি করেন, আমরা দালালদের মাধ্যমে রোগী ধরি না।
এটি শুধু একটি ঘটনা নয়, অন্যান্য বেসরকারি হাসপাতালেও এটি ঘটছে। চার দিনের চিকিৎসার জন্য ১ লাখ ২৬ হাজার টাকা দিতে না পারায় গত ৬ জানুয়ারি হাসপাতালের মালিক গোলাম সারোয়ার শ্যামলীর ‘আমার বাংলাদেশ হাসপাতাল’ থেকে যমজ সন্তানদের বের করে দেন। দুই সন্তানকে নিয়ে ঢামেক হাসপাতালে নেওয়ার পথে আয়েশা আক্তার মারা যান।
কলেজগেট এলাকায় শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের বিপরীতে মুক্তিযোদ্ধা টাওয়ার। এই ভবনে ছয়টি বেসরকারি হাসপাতাল রয়েছে- ঢাকা হেলথ কেয়ার হাসপাতাল, প্রাইম হাসপাতাল, রয়েল মাল্টিস্পেশালিটি হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, রেমেডি কেয়ার হাসপাতাল, লাইফ কেয়ার জেনারেল হাসপাতাল এবং যমুনা হাসপাতাল। ব্লাড ব্যাঙ্কও আছে। উপযুক্ত জনবলের অভাবে এবং দালালদের মাধ্যমে রোগী বিতরণের কারণে ছয় মাস আগে স্বাস্থ্য অধিদফতর এসব হাসপাতাল বন্ধ করে দেয়। কিছুক্ষণ পর আবার চালু হয়।
শ্যামলী থেকে কলেজগেট পর্যন্ত রাস্তার পাশে এবং মহল্লার ভেতরে আরও কয়েকটি ভবনে বেসরকারি হাসপাতাল দেখা গেছে। এসব হাসপাতালের বেশির ভাগই নিম্নমানের। পর্যাপ্ত চিকিৎসক ও নার্স নেই। দায়িত্বে থাকা ডাক্তার একেবারেই নতুন।