• বাংলা
  • English
  • আন্তর্জাতিক

    সময় গড়ায়, আশা ফুরায়

    তুরস্কের কাহরামানমারাস ভূমিকম্পে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোর মধ্যে একটি। মঙ্গলবার রাতে ৪০ ঘণ্টা পর ধ্বংসস্তূপ থেকে এক কিশোরীকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। ১৪ বছরের শিশুটি ব্যথায় প্রথম যে কথাটি বলেছিল তা হল – ‘দয়া করে আমার বাবাকেও বাঁচান।’ সে বলল তার বাবা কাছেই আছে। পরে রাতে বাবাসহ তার পরিবারের দুই সদস্যকে উদ্ধার করা হয়। কিন্তু তারা ছিল প্রাণহীন।

    সময় যত যাচ্ছে, তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভবনের ধ্বংসস্তূপে আটকে পড়াদের উদ্ধারের আশা ম্লান হয়ে যাচ্ছে। সোমবার ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পের পর তিন দিন কেটে গেছে। বহু মানুষকে উদ্ধার করা সম্ভব হলেও এখনও হাজার হাজার মানুষ ভবনের নিচে আটকে আছে। প্রচণ্ড ঠান্ডা সত্ত্বেও উদ্ধারকর্মীরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কমে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে মৃত্যু। ইতোমধ্যে দুই দেশে মৃতের সংখ্যা ১১ হাজার ছাড়িয়েছে। শুধু তুরস্কেই মারা গেছেন ৮ হাজার ৫৭৪ জন। সিরিয়ায় মারা গেছে ২ হাজার ৫৩০ জন। দুই দেশের ভূমিকম্পে আহত হয়েছেন ২০ হাজারের বেশি মানুষ। ক্ষুধা ও প্রচণ্ড শীত শোকাহতদের কষ্ট বাড়িয়ে দিয়েছে।

    তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভূমিকম্পে নিহতদের স্মরণে এক দিনের জাতীয় শোক ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ সরকার। গতকাল এক প্রজ্ঞাপনে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার দেশের সব সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশী মিশনগুলোতে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে। এছাড়া দেশের সব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে বিশেষ মোনাজাত করা হবে।

    সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত তুরস্কে ব্যাপক উদ্ধার অভিযান চলছে। তবে ধ্বংসযজ্ঞের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় উদ্ধার করা কঠিন হয়ে পড়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা থেকে তুর্কি সাংবাদিক ইব্রাহিম হাসকোলোলু বলেছেন, বহু মানুষ এখনও (ধ্বসে) ভবনের নিচে রয়েছে। তাদের সাহায্য দরকার। তিনি বলেন, ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়া লোকজন তাকে এবং অন্যান্য সাংবাদিকদের ভিডিও, ভয়েস নোট এবং তাদের লাইভ অবস্থান পাঠাচ্ছে। “তারা আমাদের বলছে তারা কোথায় আছে,” তিনি বলেন। কিন্তু তাদের জন্য কিছুই করা যাচ্ছে না। দক্ষিণ তুরস্কের নুমুন জেলার বাসিন্দা আরজু দেদিওগলু জানান, তার দুই ভাগ্নে আয়শাগুল এবং ইলাইদা ভবনের ধ্বংসস্তূপে আটকা পড়েছেন। কিন্তু তাদের উদ্ধারে কোনো উদ্যোগ নেই। তিনি বলেন, তিনি নিশ্চিত যে তারা আর বেঁচে নেই।

    তবে গতকাল অনেককে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। তুরস্কে ৫২ ঘণ্টা পর ওয়াইজিৎ চাকমাক নামের আট বছরের এক শিশুকে উদ্ধার করা হয়েছে। ধ্বংসস্তূপের ভিতর ওয়াজিৎ কাঁদছিল। তার মা বাইরে অপেক্ষা করছিলেন। উদ্ধারের পর এক আবেগঘন পরিস্থিতি তৈরি হয়। আবেগাপ্লুত মা তার ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। ৫৬ ঘন্টা এই আস্তিনে আটকে থাকার পর ১৬ বছর বয়সী মাহমুত সালমানকে উদ্ধার করা হয়। তার ধুলোমাখা হাসিমাখা মুখের ছবি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।

    ভূমিকম্পের আফটারশকের আতঙ্কে অনেকেই বৃষ্টি ও তুষারে রাত কাটাচ্ছেন। তাদের খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির প্রয়োজন রয়েছে। হাতায় আতাকিয়া নামে একজন ৬০ বছর বয়সী বলেন, তারা ভূমিকম্প থেকে বেঁচে গেলেও এখন ক্ষুধা ও ঠান্ডায় মৃত্যুর মুখোমুখি।

    এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের ৭০টির বেশি দেশ তুরস্কের প্রতি তাদের সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। হাজার হাজার উদ্ধারকর্মী ডগ স্কোয়াড নিয়ে অভিযান চালাচ্ছেন। উদ্ধারকাজে ক্রেনের মতো ভারী যন্ত্রপাতিরও ব্যবহার দেখা যাচ্ছে। তবে তুরস্কের তুলনায় বিশ্বের খুব কম দেশ ও সংস্থা গৃহযুদ্ধ বিধ্বস্ত সিরিয়ার পাশে দাঁড়িয়েছে। উত্তর সিরিয়ায় ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়ারা সাহায্যের জন্য চিৎকার করছে। কিন্তু তাদের ডাকে সাড়া দেওয়ার কেউ নেই। হোয়াইট হেলমেটস ইমার্জেন্সি রেসপন্স গ্রুপ, উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ার বিদ্রোহী-নিয়ন্ত্রিত এলাকায় একটি সাহায্যকারী গোষ্ঠী বলছে, ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়াদের বাঁচাতে সময় ফুরিয়ে আসছে। গৃহহীন হয়ে পড়েছেন বহু মানুষ। এ প্রেক্ষাপটে ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশের কাছে সাহায্যের আহ্বান জানিয়েছে সিরিয়া সরকার।

    আল জাজিরার সোহাইব আল-খালাফ সিরিয়ার বিদ্রোহী-নিয়ন্ত্রিত সালকিন অঞ্চল থেকে বলেছেন যে চিকিত্সার জন্য কোনও হাসপাতালের শয্যা নেই। হাসপাতালের বাইরে অনেক আহতদের চিকিৎসার চেষ্টা চলছে।

    ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোর অধিকাংশই বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। সাংবাদিকরা বলছেন, যুদ্ধ ও সংঘর্ষের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় উদ্ধারকাজ ব্যাহত হচ্ছে। এসব এলাকায় রুশ সমর্থিত সরকারি বাহিনী, জিহাদি, তুর্কি-সমর্থিত বিদ্রোহী এবং কুর্দি নেতৃত্বাধীন যোদ্ধাদের মধ্যে লড়াই চলছে।

    এদিকে, প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বুধবার দক্ষিণ তুরস্কের ক্ষতিগ্রস্ত কাহরামানমারাস পরিদর্শন করেছেন। এ সময় স্থানীয়রা উদ্ধারকাজে ধীরগতিতে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এরদোয়ান স্বীকার করেছেন যে প্রাথমিক পর্যায়ে উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করতে কিছু সমস্যা ছিল। তবে এখন নির্বিঘ্নে চলছে উদ্ধারকাজ। তিনি বলেন, প্রথমে রাস্তা ও বিমানবন্দরের কারণে একটু সমস্যা হয়েছিল।

    তুরস্ক বিশ্বের সবচেয়ে সক্রিয় সিসমিক অঞ্চলগুলির মধ্যে একটি। ১৯৯৯ সালে, দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে একটি শক্তিশালী ভূমিকম্পে ১৭,০০০ এরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছিল। এবার আরও প্রাণহানির আশঙ্কা করা হচ্ছে

    মন্তব্য করুন