সংস্কার নিশ্চিত করেই ঋণ দেবে আইএমএফ
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে বাজেট সহায়তা এবং বৈদেশিক মুদ্রার ভারসাম্য হিসেবে ঋণ নেওয়ার আনুষ্ঠানিক আলোচনা আজ ঢাকায় শুরু হচ্ছে। আইএমএফ প্রতিনিধিদল দুই সপ্তাহ ধরে বাংলাদেশের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করবে। তারা বেসরকারি খাত এবং কয়েকটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও বৈঠক করবেন।
বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা সফল হলে আইএমএফ তাদের এক্সটেনডেড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি (ইসিএফ) এবং নতুন প্রোগ্রাম রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটি (আরএসএফ)-এর আওতায় ঋণ দেবে। আইএমএফের কর্মসূচির আওতায় ঋণ পেতে উচ্চ মাত্রার সংস্কার প্রয়োজন। এই কর্মসূচি সম্পর্কে সংস্থাটির ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, এর আওতায় ঋণ পাওয়ার জন্য সুবিন্যস্ত শর্তাবলী রয়েছে। এই শর্তগুলো সংস্কারের সাথে সম্পর্কিত। এর আওতায় প্রতিটি কিস্তি ছাড়ার আগে প্রয়োজনীয় সংস্কার নিশ্চিত করতে হবে।
গত জুলাই মাসে অর্থ মন্ত্রণালয় আইএমএফের কাছে ঋণ চেয়ে একটি আনুষ্ঠানিক চিঠি পাঠায়। এর আগে অর্থনীতির অবস্থা পর্যালোচনা করতে আইএমএফের ‘আর্টিকেল-ফোর’ মিশন ঢাকায় এসেছে। ওই মিশনের চূড়ান্ত বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পাশাপাশি তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কথা ভাবছে। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রক্ষা করা খুবই জরুরি বলে মনে করছে আইএমএফ। কারণ, বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য অনেক চাপের মধ্যে রয়েছে। এ ছাড়া আর্থিক খাতে সংস্কার জরুরি। ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ কমাতে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী শ্রেণিবিন্যাস ও বিধান চায় সংস্থাটি। এ ছাড়া তারা সম্প্রতি রাজস্ব প্রশাসনে আরও সংস্কার আনার কথা বলছেন, যার মধ্যে ভ্যাট হার কাঠামো সরলীকরণ, পুরো রাজস্ব আদায় ব্যবস্থা আধুনিকায়ন করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, সরকার আইএমএফের কাছে সাড়ে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ চেয়েছে। তবে এই কর্মসূচির আওতায় তাদের ৬৮০ কোটি ডলার পর্যন্ত ঋণ নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। তারা সম্ভাব্য ৯ কিস্তিতে তিন বছরের মধ্যে ঋণ পরিশোধ করতে পারবেন। পরিশোধের সময়কাল কয়েক বছরের গ্রেস পিরিয়ড সহ ২০ বছর পর্যন্ত হতে পারে। এর মানে প্রথম কিস্তি শুরু হতে অনেক সময় লাগবে। IMF ওয়েবসাইট অনুসারে, RSF তহবিল থেকে ঋণের মেয়াদ ২০ বছর এবং গ্রেস পিরিয়ড ১০ বছর। এই ঋণে সংস্কারের শর্ত থাকলেও সুদের হার নমনীয়।
তিনি আরও বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে আইএমএফ যেসব সংস্কারের কথা বলছে তার সবগুলোই ঋণ সংক্রান্ত আলোচনার ক্ষেত্রে হবে না। কিছু বিষয় নতুন যোগ করা হতে পারে. এর বাইরে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোকে সাহায্য করাই আরএসএফ কর্মসূচির মূল উদ্দেশ্য। কার্বন ট্যাক্স সহ জলবায়ুর প্রভাব মোকাবেলায় ঋণ আলোচনা কিছু সংস্কার সুপারিশ নিয়ে আসতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদারের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল গত ১০ থেকে ১৬ অক্টোবর ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের বার্ষিক বৈঠকে অংশ নেয়। জানা যায়, বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে একাধিক বৈঠকে আইএমএফ কর্মকর্তারা বলেছেন, তারা ঋণ দিতে আগ্রহী। তবে তারা আর্থিক খাত ও রাজস্ব প্রশাসনসহ কিছু ক্ষেত্রে সংস্কার চান।
পূর্বের IMF পজিশন পেপারে বলা হয়েছে যে পর্যাপ্ত রাজস্ব এবং উচ্চ ভর্তুকির অভাবে বাজেট ঘাটতি পূরণের জন্য অভ্যন্তরীণ উত্স থেকে উচ্চ-মূল্যের ঋণের উপর সরকারের নির্ভরতা বেড়েছে। এ কারণে আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যের জায়গা সংকুচিত হচ্ছে। এ অবস্থায় আর্থিকভাবে টেকসই উন্নয়ন, সামাজিক ও জলবায়ু লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে রাজস্ব বাড়ানো এবং সরকারি ব্যয় যৌক্তিককরণ করাই সময়ের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। তবে দরিদ্র এবং দুর্বল জনগোষ্ঠীকে অবশ্যই করোনা এবং বৈশ্বিক ধাক্কা মোকাবেলায় সহায়তা অব্যাহত রাখতে হবে।
গত আগস্টে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম প্রায় ৫০ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার। সরকারের এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে আইএমএফের ঋণ পাওয়ার শর্ত জড়িয়ে যেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে তাদের সঙ্গে ঋণ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়নি বলে আইএমএফ থেকে জানানো হয়েছে। সরকারের এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে আইএমএফের কোনো সম্পর্ক নেই।
উচ্চ আমদানি ব্যয়ের চাপে কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে। বর্তমান রিজার্ভ ৩৬ কোটি ডলারের নিচে। এদিকে, বৈশ্বিক অনিশ্চয়তা এবং মন্দার আশঙ্কায় সম্প্রতি রপ্তানি ও রেমিট্যান্স কমেছে। এ কারণে মজুদ নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। সরকার এখন খরচ মেটাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে দিচ্ছে। এ অবস্থায় আইএমএফের ঋণ নিয়েও আলোচনা হচ্ছে রাজনৈতিক মহলে।