সংবিধানের কপি যেন ‘সোনার হরিণ’
রাষ্ট্রের এই গুরুত্বপূর্ণ নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাংলাদেশের সংবিধান মেনে চলা প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য। আপনি যদি এটি গ্রহণ করতে চান তবে আপনাকে এটি জানতে হবে। কিন্তু সংবিধানের আসল কপি পাওয়া সাধারণ নাগরিকের কাছে ‘সোনার হরিণ’-এর সমান। সংবিধানের অকাট্য শব্দটি কেবল ঠোঁটসেবা।
বাংলাদেশের সকল আইন ও বিধি-বিধানের মূল উৎস হলো দেশের সংবিধান। এটি সরকারী ব্যবস্থা থেকে শুরু করে প্রতিটি নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্য বর্ণনা করে। সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী সকল আইন ও প্রবিধান প্রণীত হয়।
সংবিধানে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, স্বাধীনতার ঘোষণা, স্বাধীনতার ঘোষণা, সংবিধানের প্রস্তাবনাও রয়েছে, যা বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে অনন্য। এসব বিষয়ে ব্যাপক প্রচারণার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। যাইহোক, ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে ১৬ কোটিরও বেশি নাগরিকের জন্য সংবিধানের মাত্র ৩০০০ কপি ছাপা হয়েছিল। ফলস্বরূপ, এটি সাধারণ মানুষ থেকে দূরে, এমনকি সরকারের কিছু মন্ত্রণালয় ও বিভাগও তা পায়নি। এরপর থেকে দীর্ঘ ৬ বছর নানা জটিলতায় দেশের সর্বোচ্চ নথিটি ছাপার বাইরে রয়েছে। যদিও সংবিধানের ১৭ তম সংশোধনী ২০১৮ সালে পাস হয়েছিল, এটি মুদ্রিত আকারে কখনও প্রকাশিত হয়নি। এছাড়া, ২০১৬ সালে প্রকাশিত সংবিধানে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে শতাধিক ভুল চিহ্নিত করায় পরবর্তীতে সংবিধান ছাপা না হওয়ায় সংশোধন করা যায়নি।
দেখা গেছে, হাইকোর্টের বিচারপতিদের অপসারণ সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আপিল বিভাগের রায়ে বাতিল হওয়ার পর সেই রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। এটি এখন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, রিভিউ পিটিশন নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত সংবিধান ছাপা হচ্ছে না।
গত এক দশকে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে এই সংশোধনীর মাধ্যমে হাইকোর্টের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদে ন্যস্ত হয়। পরে হাইকোর্ট প্রথমে সংশোধনী বাতিল করে রায় দেন। আপিল বিভাগও হাইকোর্টের রায় বহাল রেখেছেন। এখন সেই রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন নিষ্পত্তির প্রস্তুতি চলছে। এদিকে সরকারি উদ্যোগ ছাড়া সংবিধান ছাপানোর এখতিয়ার কোনো বেসরকারি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নেই। ফলে সংবিধানের নাগরিক চর্চা কার্যত ব্যাহত হচ্ছে। কিন্তু ইন্টারনেটের এই যুগে সংবিধানের ডিজিটাল সংস্করণ পাওয়া কঠিন নয়। তবে সরকারিভাবে প্রকাশিত সংবিধানের মূল কপি সংগ্রহ করতে পারছেন না আইনের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষ। তারা অবৈধভাবে প্রকাশিত সংবিধানের কপি সংগ্রহ করতে বাধ্য হচ্ছে অতিরিক্ত রুপিতে। কপিরাইট আইন অনুযায়ী, সংবিধান প্রকাশের আইনি এখতিয়ার একমাত্র সরকারের রয়েছে।
১৯৭২ সালে দেশের প্রথম সংবিধান প্রণয়ন কমিটির আহ্বায়ক বিশিষ্ট আইনজীবী ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘প্রত্যেক নাগরিকের কাছে সংবিধানের কপি পৌঁছে দেওয়া সরকারের দায়িত্ব। যখন সেটা হচ্ছে না, অন্তত সংবিধানের প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করতে হবে। বিক্রির দাম যত কম হবে তত ভালো। সরকারের উচিত এমন উদ্যোগ নেওয়া।’
তার মতে, প্রতিটি নাগরিকের উচিত সংবিধান পড়ে রাষ্ট্রের প্রতি তার কর্তব্য পালন করা এবং রাষ্ট্রের কাছ থেকে তার যে অধিকার রয়েছে সে সম্পর্কেও সচেতন হওয়া। সংবিধান ছাপার জটিলতা প্রসঙ্গে ড. কামাল বলেন, সরকার যত খুশি ছাপতে পারে। এটা সরকারের সিদ্ধান্তের বিষয়।
বেসরকারী ব্যবস্থাপনায় সংবিধান ছাপানো যাবে কিনা জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘কপিরাইট সরকারের কাছে থাকা দরকার। কারণ আমাদের দেশে বিভিন্ন নথিপত্রে অনেক ধরনের বিকৃতি দেখা যায়।’
সংবিধান রাষ্ট্রের ভূখণ্ড ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক। সংবিধানের বাইরে কোনো আইন ও বিধি প্রণীত হলে তা বাতিল। সংবিধানে আরও বলা হয়েছে, দেশের নাগরিকদের সংবিধান ও আইন মানা ও জানা উচিত।
সংবিধানের ২১(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সংবিধান ও আইন মান্য করা, শৃঙ্খলা রক্ষা করা, নাগরিক দায়িত্ব পালন করা এবং জাতীয় সম্পত্তি রক্ষা করা প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য।’ সংবিধানের ১৯ অনুচ্ছেদে সব নাগরিকের জন্য ‘সুযোগের সমতা’ নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্রকে উদ্যোগ নিতে হবে। অনুচ্ছেদ ১৯ (১) বলে, ‘রাষ্ট্র সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করার চেষ্টা করবে।’ ১৯(২) ধারায় বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র জনগণের মধ্যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে, নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের সুষম বণ্টন এবং সমতা অর্জনের জন্য ন্যায়সঙ্গত সুযোগ নিশ্চিত করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।