সংকটকালে হাওর ফ্লাইওভার নিয়ে সমালোচনা
ডলার সংকটের পর দেশে এখন টাকার সংকটও দেখা দিয়েছে। মহামারী করোনা, রাশিয়া-ইউক্রেন পরিস্থিতি এবং গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটের প্রভাব প্রশমিত করার জন্য ইতিমধ্যে কঠোরতা নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যাপক কাটছাঁট করা হয়েছে। বাস্তবায়ন পর্যায়ে থাকা ৮৫টি প্রকল্পের বরাদ্দ মাঝপথে স্থগিত করা হয়েছে। ৬৩৬টি প্রকল্পের ২৫ শতাংশ বরাদ্দ স্থগিত করা হয়েছে। খুব গুরুত্বপূর্ণ না হলে নতুন প্রকল্প গ্রহণ করবে না। পুনর্বিবেচনায় আরও অর্থ জড়িত থাকলে পুরানো প্রকল্পগুলি স্থগিত করা হচ্ছে। মন্ত্রণালয় ও বিভাগ থেকে আসা প্রকল্পগুলো ফেরত দিচ্ছে পরিকল্পনা কমিশন। এমন বাস্তবতায় সড়ক উন্নয়নে ধান বাজারজাত করতে ৫ হাজার ৬৫১ কোটি টাকার প্রকল্প নিচ্ছে সরকার। প্রকল্পটির অন্যান্য কম গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য রয়েছে যেমন সমস্ত-মৌসুম পরিবহন সংযোগ স্থাপন এবং পর্যটন বিকাশ। কিশোরগঞ্জের মিঠামিন উপজেলা সদর থেকে করিমগঞ্জের মরিচখালী পর্যন্ত ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হবে। ৪৩৩ কোটি টাকা ব্যয়ে বিদ্যমান সাড়ে ১৩ কিলোমিটার সড়ক প্রশস্ত করা হবে। জমি অধিগ্রহণ ও ক্ষতিপূরণ বাবদ ৫০০ কোটি টাকা ব্যয় করা হবে। তবে এই মেগা প্রকল্প নিয়ে শুরু হয়েছে আলোচনা-সমালোচনা।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন মনে করেন, এই মুহূর্তে এ ধরনের প্রকল্পের কোনো যৌক্তিকতা নেই। এগুলো রাজনৈতিক অর্থনীতির বিষয় হতে পারে। তিনি আরও বলেন, ব্যয়ের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সরকার কঠোর পরিশ্রমের নীতি গ্রহণ করেছে। যাতে খরচ সাশ্রয়, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা থাকে। এর মধ্যে এত বড় ব্যয়ের খাতকে কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে যুক্ত করার অর্থ হচ্ছে উন্নয়ন খাতের শৃঙ্খলার প্রতি সরকার আসলেই মাথা ঘামায় না।
‘কিশোরগঞ্জ জেলার মিঠামিন উপজেলা সদর থেকে করিমগঞ্জের মরিচখালী পর্যন্ত ফ্লাইওভার সড়ক নির্মাণ’ নামের প্রকল্পের কাজ চলতি মাস থেকে শুরু করতে চায় সেতু বিভাগ। পাঁচ বছর মেয়াদী প্রকল্পটি ২০২৮ সালের মধ্যে শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে। আগামী মঙ্গলবার অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে। বৈঠকে একনেক চেয়ারপারসন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অংশ নেবেন।
পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগ প্রকল্পটি যাচাই-বাছাই করেছে। আর্থিক সংকটের সময় এত কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প কেন নেওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে সদস্য সরকারের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সচিব মো. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়া বলেন, প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করে একনেকে অনুমোদনের জন্য সুপারিশ করা হয়। এছাড়া প্রকল্পে এখন অর্থ লাগবে না। সব প্রক্রিয়া শেষে অন্তত দেড় বছর পর টাকা লাগবে। সেদিকে প্রকল্প অনুমোদন হলে কাজ চলবে। তবে প্রকল্পটি আদৌ বাস্তবায়িত হবে কি না সে বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে একনেক।
কিশোরগঞ্জে এ ধরনের প্রকল্প গ্রহণের যৌক্তিকতা সম্পর্কে প্রকল্প নথিতে বলা হয়েছে, ভৌগোলিকভাবে হাওর অঞ্চল পশ্চাৎপদ। বছরের ছয় মাস থাকে পানির নিচে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, যোগাযোগ ও শিক্ষার ক্ষেত্রে বিকশিত হয়নি। বছরে মাত্র একবার বোরো কাটা হয়। উন্নত রাস্তাঘাট না থাকায় উৎপাদিত চাল বাজারজাত করা কঠিন হয়ে পড়েছে। হাওর অঞ্চল বন্যাপ্রবণ। প্রকল্প এলাকায় পর্যটন সম্ভাবনা রয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে স্থানীয় পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটবে।
প্রকল্প এলাকা কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ এই জেলার মিঠামইনে জন্মগ্রহণ করেন। সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান ও দেশের প্রথম অন্তর্বর্তী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের জন্ম কিশোরগঞ্জে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামও কিশোরগঞ্জের সন্তান।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) বৈঠকে প্রকল্পের অর্থায়ন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সরকারি অনুদান প্রাপ্তির জন্য বিদ্যমান পদ্ধতি অনুসরণ করা ব্যয়ের অন্তর্ভুক্ত। এই পর্যবেক্ষণের প্রতিক্রিয়ায় সেতু বিভাগ জানিয়েছে, সেতু কর্তৃপক্ষ আগামী ৩৫ বছরের মধ্যে পদ্মা সেতু প্রকল্পের পুরো টাকা সুদসহ অর্থ বিভাগকে পরিশোধ করবে।