শিল্পপণ্য ঘোষণায় বহুমুখী করের ঝুঁকিতে রাবার চাষ
অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও প্রথম দিকে রাবার চাষকে একটি কৃষিপণ্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ফলে এ খাতের উন্নয়নে কৃষি ব্যাংকের ঋণ সহজলভ্য ছিল। কিন্তু সরকার রাবারকে শিল্প পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ায় রাবার বাগান এবং রাবার উৎপাদন বহুপাক্ষিক করের ফাঁদে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
ইতিমধ্যে দেশে রাবার আমদানি করলে ৫ শতাংশ কর দিতে হয়। আর দেশে উৎপাদন করলে ১৫ শতাংশ মুসাক দিতে হয়। সংশ্লিষ্ট কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তা জানান, একদিকে কাঁচা রাবারের দাম কমেছে; অন্যদিকে উৎপাদন পর্যায়ে আরো কর আরোপ করা হয়েছে। তাই রাবার বাগান মালিকদের অহেতুক হয়রানি না করতে ভ্যাট কর্মকর্তাদের মৌখিকভাবে বলা হয়েছে। কিন্তু আমরা খবর পাচ্ছি যে তারা প্রায়ই বাগানে হামলা করছে। অনেক মালিক এ নিয়ে কোনো ঝামেলায় না গিয়ে টাকা পরিশোধ করছেন। মালিকরা বাধ্য হয়েই এই টাকা দিচ্ছেন।
সূত্র জানায়, ১৯৫২ সাল থেকে বাংলাদেশে রাবার চাষের প্রক্রিয়া শুরু হয় চট্টগ্রাম ও টাঙ্গাইল এলাকায়। পরে সুফল পাওয়া গেলে এদেশে প্রথমে সরকারি এবং আশির দশকে বেসরকারি উদ্যোগে রাবার চাষ শুরু হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে রাবারের বার্ষিক চাহিদা ৩৫ হাজার টন। আর দেশের মোট উৎপাদন ২৫ হাজার টন। আমদানি হয় ২০ হাজার টন। কারণ দেশে উৎপাদিত কিছু রাবার শিট ভারত, ভিয়েতনাম ও মালয়েশিয়ায় রপ্তানি হয়।
বাংলাদেশের মতো ভারত, ভিয়েতনাম ও মালয়েশিয়াও বিগত বছরগুলোতে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে। কিন্তু তাদের দেশে রাবার কৃষিপণ্য হিসেবে স্বীকৃত। তাই বাংলাদেশের রাবার বাগান মালিকদের দাবি, এটিকে এ দেশেও কৃষি পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে।
বাংলাদেশ রাবার প্ল্যান্টেশন ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাইফ উল্লাহ মনসুর বলেন, কৃষিপণ্যের ওপর কর আরোপের কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু যখন রাবার একটি শিল্প পণ্য হিসাবে স্বীকৃত হয়, তখন অন্যান্য শিল্প পণ্যের মতো রাবার উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে একাধিক কর দিতে হয়। তিনি বলেন, ১৯৮০-৮১ সালে ইজারা নেওয়া বাগানগুলোর ইজারার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। আমরা যদি অন্যান্য সরকারী ইজারাকৃত জমির মত রাবার বাগানের ইজারা নবায়ন করি এবং রাবার চাষকে কৃষিপণ্য হিসাবে ঘোষণা করি তাহলে আমরা আশা করি আমাদের দেশ অচিরেই রাবার চাষে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠবে। তাহলে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে রাবার নতুন পণ্য হিসেবে আমাদের রপ্তানি বাণিজ্যে যুক্ত হবে।
বাংলাদেশ রাবার বোর্ডের চেয়ারম্যান সৈয়দা সারোয়ার জাহান বলেন, রাবার বাগান ও রাবার উৎপাদন এখন বন মন্ত্রণালয়ের অধীনে। কারণ রাবারের বিষয়টি বন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বেশি জড়িত। কার্বন সিকোয়েস্টেশন, অক্সিজেন উৎপাদন এবং পরবর্তীতে উন্নত আসবাবপত্র তৈরিতে রাবার গাছের সজ্জা থেকে রাবার উৎপাদনের চেয়ে রাবার গাছের ভূমিকা অনেক বেশি। কর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরকার চাইলে রাবার উৎপাদকদের কাছ থেকে কর কম নিতে পারে। অথবা দেশীয় উৎপাদকদের সুরক্ষার জন্য আমদানি শুল্ক বাড়ানো হতে পারে।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১৩ সালের ৫ মে রাবার বোর্ড গঠন করা হয়। একাধিক বাগান মালিক জানান, বোর্ডের চেয়ারম্যানসহ অন্যান্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে মনে হচ্ছে তারা আমাদের অভিভাবকের ভূমিকা নিতে চান। এতে আমরাও সন্তুষ্ট। আমরা চাই রাবার বোর্ড আমাদের মাল্টিটাস্কিং এর চাপ থেকে মুক্ত করুক।
মমিনুল হক চৌধুরী নামে এক রাবার বাগান মালিক বলেন, নাইক্ষ্যংছড়ির বৈশারী আমার জন্য বরাদ্দকৃত চা বাগানের জমি খুঁজে পেতে ১৭ বছর লেগেছে। কক্সবাজারের ঈদগাঁও থেকে প্রতিদিন চার ঘণ্টা হেঁটে বাগানে যেতে হয়। এখন সেই জায়গায় গাছ লাগিয়ে রাস্তা করেছি। আমরা যখন পতিত জমিকে রাবার বাগানে রূপান্তরিত করি এবং এটি একটি প্রতিশ্রুতিশীল খাতে পরিণত হয়, তখন কর বিভাগের লোকেরা বাগানগুলিতে অভিযান শুরু করে।
১৯৮০ সালে, পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্জ্য জমি রাবার বাগানের জন্য ইজারা দেওয়া হয়েছিল। প্রতিটি মালিককে ২৫ একর জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। রাবারকে কৃষিপণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান, এলাকায় বসতি স্থাপন এবং বনায়নের জন্য কৃষি ব্যাংক ঋণ প্রদানেরও সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু দুই দশক আগে কৃষিপণ্য থেকে রাবার কাগজভিত্তিক শিল্প পণ্যে রূপান্তরের পর কৃষি ব্যাংকের ঋণ দেওয়া বন্ধ হয়ে যায়। বাংলাদেশ রাবার বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, দেশে সরকারি-বেসরকারি বড়-ছোট বাগান মিলিয়ে প্রায় এক লাখ একর জমিতে রাবার চাষ হচ্ছে।