লোডশেডিংয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের।এলাকা: পুরান ঢাকা
এক মাস আগেও দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেলেও কাজের চাপে দমবন্ধ করার মেজাজে ছিলেন না কর্মশালার কর্মীরা। দুপুরের খাবারের জন্য পালা নিতে হলো। গতকাল বুধবার বিকেল ৩টায় নারিন্দার দক্ষিণ মৈশুন্দি মহল্লায় গিয়ে দেখা যায়, চল্লিশজন ওয়ার্কশপের মালিক-কর্মচারীরা অলস সময় কাটাচ্ছেন। কেউ কেউ মোবাইলে লুডু গেম খেলছে। কারণ কী- জ্যেষ্ঠের প্রশ্নের উত্তরে, দুপুরের চেয়ে গরম, ‘বিদ্যুৎ নেই। কারখানা বন্ধ। কাজও বন্ধ।
বিদ্যুৎ না থাকলে জেনারেটরে কারখানা চালানো যাবে না- ওয়াসিমা ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের মালিক রাজীব মোহাম্মদ রানা বলেন, শুধু মাইশুন্দি নয়; পুরান ঢাকার অধিকাংশ কারখানাই ক্ষুদ্র শিল্প। প্রতিদিন এক হাজার থেকে দুই হাজার টাকা আয় করা যায়। চার ঘণ্টা লোডশেডিং করে জেনারেটর চালাতে ৬০০ টাকার অকটেন লাগবে। এতে ব্যবসা আলোকিত হবে। তাই বিদ্যুৎ চলে গেলে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এতে কাজ ও আয়ে চাপ সৃষ্টি হয়েছে এবং ব্যবসা জমে উঠেছে।
বাঁশাল মোড় পেরিয়ে ধোলাইখাল রাস্তা ছেড়ে চলে যায় ৬০০ বছরের পুরনো বিনতাবিবির মসজিদ। অন্তত ৭০ বছর আগে এই এলাকায় গড়ে ওঠা হালকা প্রকৌশল শিল্পের সমৃদ্ধিকে বিদ্যুত সংকট নাড়িয়ে দিয়েছে। মসজিদ পেরিয়ে লালমোহন সাহার রাস্তা ধরলেই দক্ষিণ মৈশুন্ডি মহল্লা। শাহজালাল ইঞ্জিনিয়ারিং আবাসিক ভবনের ফাঁকে নির্মিত শত শত ওয়ার্কশপের মধ্যে একটি। দুপুর ১২টার দিকে ওয়ার্কশপের মালিক তার কারখানার দরজায় বসে কথা হয় শাহজালালের সঙ্গে। যাইহোক, তখন বিদ্যুৎ ছিল, তাই অটো রাইস মিলের যন্ত্রাংশ হাত দিয়ে তৈরি করা হতো লেদ দিয়ে। কথার জন্য খুব একটা মন ছিল না। কারণ যে কোনো সময় বিদ্যুৎ বিভ্রাটের আশঙ্কা রয়েছে। তাই লোডশেডিং শুরুর আগেই তার কাজ শেষ করার তাড়া রয়েছে তার।
শাহজালাল বলেন, সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত কারাগার চলে। এক মাস আগেও ১০ ঘণ্টা কাজ চলছিল। এখন প্রায় ৬ ঘন্টা। কারণ বাকি সময় বিদ্যুৎ থাকে না। বুধবার সকাল ১০টায় দোকানপাট খুললে লোডশেডিং শুরু হয়। ঘণ্টাখানেক বিদ্যুৎ ছিল। বেলা ১১টায় কাজ শুরু হয়। ১০ ঘণ্টার কাজ এখন ৬ ঘণ্টায় করতে হয়।
কেমনে সামলাচ্ছেন- শাহাজালাল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, দোকানের ভাড়া মাসে ১০ হাজার টাকা। দুই কর্মচারীর বেতন ৫০ টাকা। ৩৫ হাজার। মাসিক বিদ্যুৎ বিল সাত হাজার টাকা। সব মিলিয়ে সর্বনিম্ন খরচ ৫২ হাজার টাকা। বিনিয়োগ করা হয়েছে ২০ লাখ টাকা। মাসে অন্তত ৮০,০০০ টাকা আয় না করলে সংসার চলবে না, দোকানও নষ্ট হবে। কিন্তু দিনে ৬ ঘণ্টা কাজ করে এত আয় করা সম্ভব নয়।
লালমোহন রোডের ডালিম ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপে ভারী স্টিলের পাত কাটা হয়। তৈরি মুরগির ফিড কারখানা রোলার. ডালিম বলেন, করোনা সংকট মোকাবেলা করতে না পারায় দুই কর্মচারীকে ছাঁটাই করা হয়েছে। তার পর সে নিজেই মালিক, নিজেই কর্মচারী। তিনি বলেন, চীন থেকে আসা সস্তা ও নিম্নমানের যন্ত্রাংশ নিয়ে বাজারে লাভবান হবে। নারিন্দা ও ধোলাইখালের কর্মশালায় তৈরি যন্ত্রের প্রশংসা করা হয় না। তার কারখানায় তৈরি এক জোড়া রোলারের দাম ১৩ হাজার টাকা। চীন থেকে আমদানি করা এক জোড়া মসৃণ রোলারের দাম ১২,০০০ টাকা। ইতিমধ্যেই প্রতিযোগিতায় টিকতে পারেননি, বিদ্যুৎ কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেন।
বুড়িগঙ্গার ওপারে কেরানীগঞ্জের খেজুরবাগান এলাকায় নিজ বাড়িতে থাকেন ডালিম। তিনি প্রতিদিন সকালে সেখান থেকে আসতেন। তিনি বলেন, লোডশেডিং এড়াতে সকাল ৭টায় কারখানা খুলে দেয়। রাত ১০টা পর্যন্ত থাকুন। ১৫ ঘন্টার মধ্যে ৯ থেকে ১০ ঘন্টা কাজ করতে পারে। বাকি সময় বসে থাকে। রাতে বাসায় ফিরে শান্তি নেই। মাঝরাতে বিদ্যুৎ নেই। গরমে ঘুমাবেন না। ডালিম বলেন, আমি বিদ্যুৎমন্ত্রীর এলাকায় থাকি আর বিদ্যুৎ পাই না। কেমন মাথা!’ তিনি বলেন, মঙ্গলবার রাত ১টা থেকে আড়াইটা, তিনটা থেকে সাড়ে চারটা পর্যন্ত আড়াই ঘণ্টা বিদ্যুৎ ছিল না। চার বছরের একটি মেয়ে গরমে কাতরাচ্ছিল। তাই ঘুমিয়ে পড়া মেয়েকে হাওয়া দিতে স্বামী-স্ত্রী পালা করে। এরপর ভোরে কারখানায় ছুটতে হয়। আগে বাসা থেকে দুপুরের খাবার নিয়ে আসতেন। আজকাল কেরানীগঞ্জে গ্যাস নেই। তাই খাবার আনতে পারছি না। হোটেলে খাবেন। এতে মাসিক খরচ বেড়েছে আরও হাজার তিনেক।
শাহজালাল ছাড়াও ডালিম, দুলাল হোসেন, লালমোহন সড়কের সোহাগ হোসেনসহ আরও কয়েকজন ছোট ওয়ার্কশপের মালিকের সঙ্গে কথা হয়। তাদের সবার মতে, বিদ্যুৎ বিল অস্বাভাবিক বেড়েছে। প্রিপেইড মিটারে অতিরিক্ত বিল দিয়েও বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না। দুলাল হোসেন জানান, এক বছর আগেও তিনি মাসে চার থেকে সাড়ে চার হাজার টাকার বিদ্যুৎ রিচার্জ কার্ড কিনতেন। এখন কার্ডে মাসে সাত হাজার টাকা খরচ হয়। একবার রিচার্জ করলে ৫০০ টাকা কেটে যাবে। দুলাল হোসেন কেন তা বলতে পারেননি।
ধোলাইখাল সড়কের দুই পাশে ওয়ার্কশপ, কারখানা অলিগলির কারখানার চেয়ে ব্যবসা ও আকারে বড়। তাদের মালিকরাও বলছেন, বিদ্যুতের সংকট কারণে তাদের পিঠ ভেঙে যাচ্ছে।