লোকসান এড়াতে আশ্চর্যজনকভাবে স্ক্র্যাপ বিক্রি বন্ধ!
আন্তর্জাতিক বাজারে স্ক্র্যাপ বা স্ক্র্যাপ লোহার দাম কমেছে। এ কারণে দেশের বাজারে ক্রমাগত কমছে স্ক্র্যাপের দাম। শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড মালিকরা আশ্চর্যজনকভাবে এই দাম কমতে স্ক্র্যাপ বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছেন। ফলে কম দামে লোহা, ইস্পাত ও লোহার পণ্য কেনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন ক্রেতারা।
প্রসঙ্গত, পুরনো জাহাজ বিদেশ থেকে এনে সীতাকুণ্ডে অবস্থিত শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে ভাঙা হয়। ভাঙা জাহাজের টুকরো বা স্ক্র্যাপ রি-রোলিং মিল বা স্টিল মিলগুলিতে সরবরাহ করা হয়। সেখানে তৈরি হয় লোহা, ইস্পাত ও স্টিলের পণ্য। লোকসান এড়াতে গত ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে সীতাকুণ্ডে প্রতিষ্ঠিত শিপইয়ার্ড মালিকরা যৌথ সভায় এ সিদ্ধান্ত নেন।
তাদের যুক্তি, আকরিক লোহা বেশি দামে কিনে কম দামে বিক্রি করলে শিপইয়ার্ডগুলো দেউলিয়া হয়ে যাবে। এ কারণে তারা এই অভিনব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। শিপইয়ার্ড থেকে স্ক্র্যাপ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ইস্পাত ও লোহা উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত কারখানাগুলো কাঁচামালের সংকটে পড়বে। আর কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হলে সরবরাহ কমে যাবে।
এর প্রভাব পড়বে দেশের অবকাঠামোতে। ইস্পাত স্ক্র্যাপ ক্রেতারা শিপইয়ার্ড থেকে স্ক্র্যাপ কিনে দেশের স্টিল মিলগুলিতে সরবরাহ করে। তাদের সংগঠন স্টিল স্ক্র্যাপ বায়ার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ জান্নাতুল ইসলাম বলেন, শিপইয়ার্ড মালিকরা কোনো বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে স্ক্র্যাপ বিক্রি বন্ধ করে দেন। এটা একটা কঠিন সিদ্ধান্ত। বিশ্ববাজারে জাহাজ ও লোহার দাম কমলেও এর সুফল পাচ্ছেন না দেশের ক্রেতারা।
তিনি বলেন, সেপ্টেম্বরের শুরুতে শিপইয়ার্ড মালিকরা প্রতি টন স্ক্র্যাপ ৭২ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন। দাম কমে যাওয়ায় গত ১২ সেপ্টেম্বর বিক্রি হয়েছিল ৬৫ হাজার টাকায়। যাতে আরও কমতে না পারে, একচেটিয়াদের দ্বারা বিক্রি বন্ধ করা হয়।
স্টিল মিলগুলো শিপইয়ার্ড থেকে স্ক্র্যাপ কেনে। সরবরাহ বন্ধ থাকায় তারাও সমস্যায় পড়েছেন। জানতে চাইলে বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচার অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি শেখ মাশাদুল আলম মাসুদ বলেন, বেশি দামে কিনে কম দামে বিক্রি করতে শিপইয়ার্ড থেকে স্ক্র্যাপ বিক্রি বন্ধের কোনো কারণ থাকতে পারে না। কারণ আগে যখন আপনি কম দামে কিনে বেশি দামে বিক্রি করতেন, তখন এই যুক্তি আসেনি। ব্যবসায় লাভ-ক্ষতি হতে পারে। কিন্তু লোকসান এড়াতে বন্ধ রাখা যাবে না। প্রভাবশালী কয়েকজন ইয়ার্ড মালিকের কারণে এই সিদ্ধান্ত। কিন্তু মাঝারি মানের মালিকরা লাভ-ক্ষতির কথা মাথায় রেখে ব্যবসায় টিকে থাকতে চান।
আমরা বিষয়টি ট্যারিফ কমিশনকে জানিয়েছি। শাহরিয়ার স্টিলের মালিক মাসুদ বলেন, বিভিন্ন সরকারি সংস্থাকেও জানানো হয়েছে, দ্রুত সমাধান না হলে সরকারি অবকাঠামো ও ব্যক্তিগত উন্নয়নে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
জানতে চাইলে শিপ ব্রেকিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবু তাহের বলেন, এখন যে জাহাজ ইয়ার্ডে কাটা হচ্ছে তা প্রতি টন ৬৫০ ডলারে কেনা হয়। তখন আমরা প্রতি টন ৬৬ হাজার টাকায় স্ক্র্যাপ বিক্রি করতাম। ৫৫ হাজার টাকায় নেমে এসেছে। প্রতি টন কি আমার ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা লোকসান হবে? ব্যাংক লোনের টাকা দিয়ে এই জাহাজ কিনলে। তাহলে আমি বাড়ি বিক্রি করে প্রতি টন ১০,০০০ টাকা ক্ষতি পরিশোধ করব?
ব্যবসায় লাভ-লোকসান হবেই, লোকসান এড়াতে পণ্যের দাম নির্ধারণ করা কতটা নৈতিক বলে তিনি মনে করেন, এমন প্রশ্নের জবাবে আবু তাহের বলেন, করোনার কারণে আমরা একবার দেউলিয়া হয়েছিলাম, ডলারের প্রভাব আমাদের বিপর্যস্ত করেছে। কষ্ট।” এখন আর লেঅকসানে পড়তে চাই না। এক সপ্তাহ বাজার কেমন হয় তা দেখব, তারপর সিদ্ধান্ত নেব।
জানা গেছে, দেশের মোট লৌহ আকরিকের চাহিদার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডগুলো সরবরাহ করে। রি-রোলিং মিলগুলি অবশিষ্ট স্ক্র্যাপ বা স্ক্র্যাপ লোহা সরাসরি জাহাজে আমদানি করে।
একটি শীর্ষস্থানীয় ইস্পাত গ্রুপের একজন কর্মকর্তা বলেন, স্টিল তৈরির কাঁচামাল স্ক্র্যাপ আয়রন এখন আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন ৪৩০ ডলারে পাওয়া যাচ্ছে। আগে এটি ছিল প্রতি টন ৫৬০ ডলার। ফলস্বরূপ, প্রতি টন ১৩০ ডলার কমেছে। আগামী কয়েক মাসে দাম আরও কমবে। কারণ বিশ্ববাজারে প্রতিনিয়ত কমছে পুরনো জাহাজের দাম। এই হ্রাসের সুফল ভোক্তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য, আমাদের সরাসরি স্ক্র্যাপ আমদানির জন্য ঋণপত্র খুলতে হবে।
জানা গেছে, দেশের বাজারে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ৬০ গ্রেডের এমএস রডের দাম প্রতি টন ৯৪ হাজার টাকা। নন-ব্র্যান্ডেড হলে দাম আরও কম, প্রতি টন ৮৮ থেকে ৯০ হাজার টাকা। কারখানা মালিকরা বলছেন, ঋণ খুলে আমদানি বাড়ালে রডের দাম আরও কমবে।
চট্টগ্রাম কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৯ লাখ ৭১ হাজার টন স্ক্র্যাপ জাহাজ এসেছে। বিপরীতে রাজস্ব পেয়েছে ১৪৫ কোটি টাকা। ২০২১-২২ সালে স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি ছিল ১.৮৩ মিলিয়ন টন; বিপরীতে সরকার রাজস্ব পেয়েছে ২৭৪ কোটি টাকা।