• বাংলা
  • English
  • বিবিধ

    রোহিঙ্গা শিবিরে ‘আরসা’ আতঙ্ক

    রোহিঙ্গা মাঝি (নেতা) আবদুল বাসের তার পাঁচ ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে কক্সবাজারের উখিয়ার জামতলার ১৫ নম্বর ক্যাম্পে থাকেন। আরেক নাবিক আহমদ রশিদ ক্যাম্পে বাসেরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। ৭২ ঘণ্টা আগে শনিবার রশিদকে হত্যা করা হয়। এরপর থেকে তিনি ভয় পান। তবে সোমবার বিকেল থেকে তাকে মোবাইল ফোনে প্রাণনাশের হুমকি আসছে। তারপর থেকে বাসের জীবন ‘গৃহবন্দী’। রোহিঙ্গা শিবিরে এখন আতঙ্ক বিরাজ করছে। বিশেষ করে বিভিন্ন ক্যাম্পের এক হাজার নাবিক তাদের জীবন নিয়ে আতঙ্কে রয়েছেন। একের পর এক খুনের পর আত্মগোপনে চলে গেছে অনেকে।
    রোহিঙ্গাদের অভিযোগ, মিয়ানমারভিত্তিক সশস্ত্র সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (এআরএসএ) এখন আরও বেপরোয়া। একের পর এক খুনের সঙ্গে জড়িত তারা। আধুনিক অস্ত্র ও গ্রেনেড নতুন পাওয়া যাচ্ছে। তাদের আস্তানা তুমব্রুর জিরো লাইনের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। হত্যার পর তারা গ্রাউন্ড জিরো ক্যাম্পে পালিয়ে যায়। এ কারণে অপরাধী চক্রের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
    এদিকে গত শুক্রবার উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্প-৮ থেকে গ্রেনেড উদ্ধারের ঘটনায় মোহাম্মদ নবীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে কক্সবাজারের ৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি আমির জাফর বলেন, গ্রেনেডটি দেশের বাইরের বলে মনে হচ্ছে। তবে এতে কোনো দেশের নাম লেখা নেই। গ্রেনেড উদ্ধারের ঘটনায় মামলা হয়েছে। কে বা কারা গ্রেনেড এনেছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে হঠাৎ করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মিয়ানমার সীমান্ত জুড়ে যুদ্ধ চলছে। আরও অনেক কিছু আছে। তবে আমরা ক্যাম্পের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে তৎপর।
    কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মাহফুজুল ইসলাম জানান, যার বাড়িতে গ্রেনেডটি পাওয়া গেছে তাকে আহত অবস্থায় আটক করা হয়েছে। তবে হাসপাতালে ভর্তির কারণে বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদ করা সম্ভব হয়নি। যার বাড়িতে গ্রেনেড আছে সে জানবে না- এটা হতে পারে না।
    আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মতে, গত চার মাসে ক্যাম্পে ২৪ জন নিহত হয়েছে। তাদের মধ্যে পাঁচজন আরসা সদস্য ও আটজন রোহিঙ্গা নাবিক রয়েছেন। বাকিরা সাধারণ রোহিঙ্গা। শিবিরে আরসা ছাড়াও আরএসও, ইসলামী মহাজ, নবী হুসেন ও মুন্না গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। এ ছাড়া সম্প্রতি ক্যাম্পে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র ও গ্রেনেড পাওয়া গেছে। একের পর এক অপহরণের ঘটনাও ঘটছে।
    প্রাণনাশের হুমকি পাওয়া মাঝি আবদুল বাসের বলেন, আরসা নেতা সালেহ উদ্দিনের নামে ফোনে তাকে হুমকি দেওয়া হয়েছে। ফোনের ওপাশ থেকে বলা হয়- ‘কিছু খাওয়ার থাকলে শেষবারের মতো খেয়ে নাও। বেশি সময় নেই। আরসাকে সহযোগিতা করতে হবে। নইলে মরে যাবে। পুলিশকে কোনো তথ্য দেওয়া যাবে না।’
    বাসের বলেন, রোহিঙ্গা নাবিকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ক্যাম্পে বসবাস করছেন। মৃত্যুর ভয়ে একসাথে হাঁটা।
    রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আরও বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কক্সবাজারের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যারা নিজেদের আরসার সদস্য হিসেবে পরিচয় দেয় তারা একক নিয়ন্ত্রণ চায়। ক্যাম্পে বিভিন্ন লেনদেন, সালিশ বৈঠক, মাদক ব্যবসা ও চোরাচালানে তাদের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী থাকতে চায় না। তবে মাঝিরা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় প্রশাসনকে সহযোগিতা করে আসছে। ক্যাম্পের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কথা প্রশাসনকে আগেই জানিয়েছিলেন তারা। এ কারণে মাজিদকে ‘রাস্তার কাঁটা’ বলে মনে করেন আরসা পরিচয়ধারীরা।
    আরসার পরিচয়ে যারা ক্যাম্প করছে তাদের মধ্যে রয়েছে বড় সেলিম, সাবের, মৌলভী আতাউল্লাহ, ইসমাইল, মো, নূর, মামুনুর রশিদ, জোবায়ের ও সেলিম।
    নাম প্রকাশে শঙ্কিত অপর দুই নাবিক জানান, আগে ক্যাম্পে দেশীয় অস্ত্রের ব্যবহার দেখা গেছে। ইদানীং খুনে পিস্তল ও শটগান ব্যবহার হচ্ছে। আবার কোনো ঘটনার আগে গ্রাউন্ড জিরোতে গোপন বৈঠক হয়। আরসার সন্ত্রাসীরা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে ক্যাম্পে হামলা চালিয়ে আবার পালিয়ে যায়।
    ক্যাম্পের বাসিন্দারা জানান, খুনের পাশাপাশি গুমও চলছে সমানতালে। গত রোববার টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের লেচুয়াপ্রাং এলাকায় ক্ষেত পাহারা দিতে গিয়ে চার কৃষককে অপহরণ করা হয়। পরে চার কৃষক পরিবারের কাছে ২৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। এর আগে গত ১৮ ডিসেম্বর টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের জাহাসপুরা এলাকায় খালে মাছ ধরতে গিয়ে আটজনকে অপহরণ করা হয়। তারা মুক্তিপণ দিয়ে ফিরেছে। একইভাবে গত ২৯ সেপ্টেম্বর একই উপজেলার পানখালী ও মরিচ্যাঘোনা পাহাড়ি এলাকা থেকে পাঁচ কৃষককে অপহরণ করা হয়।
    পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, গত আট দিনে চার খুনসহ আটজন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। নিহতরা সবাই নাবিক। এ ছাড়া গত বছরের শেষ চার মাসে ২৪ জন নিহত হয়েছেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, নতুন ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ নিতে গত ৪ জানুয়ারি গোপন বৈঠক করে আরসা। পাহাড়ে সংগঠনের সেকেন্ড ইন কমান্ড ওস্তাদ খালেদের নেতৃত্বে ২০ জনের একটি দল মিলিত হয়।

    মন্তব্য করুন