• বাংলা
  • English
  • জাতীয়

    মোবাইল ব্যাংকিং এ মাদকের টাকা

    ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়া সীমান্তবর্তী ছিমছাম গ্রাম আনোয়ারপুর। আনোয়ারপুর সরকার। পথে হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ে প্রাইমারি স্কুল। পরিচ্ছন্ন, পরিপাটি ক্যাম্পাস; যাইহোক, আমাকে উঠানের এক কোণে থামতে হয়েছিল। চারিদিকে কিছু খালি বোতল ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। একটি ফেনসিডিল, অন্যটি নতুন ওষুধ স্কুফ। খোঁজ নিয়ে বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা হালিমা বেগম জানান, প্রতিদিন বিকেলে দূর-দূরান্ত থেকে মোটরসাইকেলে করে মাদকসেবীদের দল গ্রামে প্রবেশ করে। স্কুলের উঠানে বসে ফেনসিডিল-স্কুফ নিয়ে খালি বোতল চারদিকে ছুড়ে মারছে।

    দেশের বিভিন্ন স্থানে মাদকের সর্বনাশা এমন দৃশ্য দেখা যায়। কঠোর প্রয়োগ, পুলিশের অভিযান, মামলা ও গ্রেফতার, এমনকি ‘ক্রসফায়ার’-এর মধ্যেও মাদকের আগ্রাসন বন্ধ হচ্ছে না। কারণ, মাদক-মাফিয়া চক্রে রয়েছে ক্ষমতাবানদের ছায়া। রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে সন্ত্রাসী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যরাও রয়েছেন এই দলে। এই তথ্যগুলো প্রায় সবাই জানে।

    তবে সামাকার ৯ মাসের গবেষণায় যা বেরিয়ে এসেছে তা চমকপ্রদ! মাদক ব্যবসার অর্থনীতি এখন দেশের ব্যাংকিং চ্যানেলগুলোকে ভরিয়ে দিয়েছে। মূলধারার ব্যাংকের পাশাপাশি মোবাইল ব্যাংকিং এখন ব্যাপক। এভাবেই মাদক ব্যবসার টাকা ‘বৈধভাবে’ লেনদেন হচ্ছে। ফলে মাদকের বিষ অতীতের মতো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে!

    মাদকের টাকা লেনদেনের জন্য ডিলাররা কীভাবে মোবাইল ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করে তার তথ্য অনুসন্ধান করেছি।আধুনিক ডিজিটাল লেনদেনের বিভিন্ন চ্যানেলে নজর রাখা। সময়ের গভীর অনুসন্ধানে অবশেষে কয়েকজন রাঘববোয়াল ধরা পড়ে।

    মোবাইল ব্যাংকিং লেনদেন

    মোঃ হামিদ। তিনি কক্সবাজারের পর্যটন শহর ভারুয়াখালীতে থাকেন। তিনি একজন দর্জি ছিলেন, তাই তিনি স্থানীয়ভাবে ‘দরজি হামিদ’ নামে পরিচিত। সম্পদের শীর্ষে ওঠার তাড়ায় সে মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে। ২০১৮ সালে চকরিয়ায় ৪০ হাজার ইয়াবাসহ ধরা পড়েন তিনি। দুই বছর কারাভোগের পর জামিনে বেরিয়ে আসেন তিনি। এরপর গত নভেম্বরে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে একাধিক সন্ত্রাসী গ্রুপের বিরুদ্ধে অত্যাধুনিক অস্ত্র বিক্রির মামলা হয়। হোসেন, লাল তান পাংখোয়া, মো. আলী আকবর ও আদিলুর রহমান নামে চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট। চক্রটি অবৈধ অস্ত্র সংগ্রহ ও বিক্রি করে আসছিল। জবানবন্দিতে তারা অস্ত্র নেটওয়ার্কের পাশাপাশি ইয়াবার একটি চক্রের কথা পুলিশকে জানায়। হামিদ বৃত্তের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

    তদন্তের একপর্যায়ে সিআইডির মানি লন্ডারিং ইউনিটের একটি সূত্র জানায়, হামিদ কারাগার থেকে বেরিয়ে ডিজিটাল মোবাইল ব্যাংকিং লেনদেনের মাধ্যমে ইয়াবা রাজ্যে প্রবেশ করেন। সিআইডির ওই ইউনিট থেকে মাদক ব্যবসায় হামিদের অন্যতম প্রধান সহযোগীর নাম ও মোবাইল ফোন নম্বর পাওয়া গেছে; তিনি ভোলায় থাকেন (নিরাপত্তার কারণে নাম গোপন)। ওই সহযোগীর সঙ্গে যোগাযোগ ও বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে হামিদের প্রায় তিন মাস লেগেছিল। এরপর ধীরে ধীরে তার কাছ থেকে হামিদের কুকীর্তির গোপন উপায় জানা যায়।

    অনুসন্ধানে জানা গেছে, ডিজিটাল মাধ্যমে মাদকের নেটওয়ার্ক শক্তিশালী করেছেন হামিদ। জেলায় ইয়াবা ব্যবসা পরিচালনার জন্য তার এজেন্টও রয়েছে। তিনি কক্সবাজার এলাকার রহিম উল্লাহ নামের এক ব্যক্তির মাধ্যমে মাদকের টাকা লেনদেন করেন। হামিদ 01796724266 এবং 01851217274 নম্বর দুটি মোবাইল ফোন ব্যবহার করে বিভিন্ন এলাকায় মাদকের নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ করতেন। এবং বিকাশের 01882918276- এই ব্যক্তিগত নম্বর ব্যবহার করে এই চক্রটি ইয়াবা বিক্রির টাকা লেনদেন করছে। নম্বরটির লেনদেনের তথ্য থেকে দেখা যায়, ১৭ আগস্ট ২০২১ থেকে গত ১৭ আগস্ট পর্যন্ত ১২ মাসে ৩১ লাখ ২৬ হাজার ১৯২ টাকা লেনদেন হয়েছে। মোট লেনদেন ৩৩৬ বার করা হয়েছে. গড় লেনদেনের পরিমাণ ৯ হাজার ৩০৪ টাকা ১৪ পয়সা।

    হামিদ নামের একজন মাদক ব্যবসায়ী খুবই বিপজ্জনক। সবকিছুতেই তার নিখুঁত পরিকল্পনা। গোয়েন্দাদের চোখ এড়াতে তৈরি করা হয়েছিল জাল জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি)। তিনি মাদক ব্যবসার জন্য 01796724266 নম্বর ব্যবহার করেন, জাল কাগজপত্র দিয়ে ওই নম্বরের সিম কার্ডটি কিনে নেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সিমকার্ড কেনার সময় হামিদ অন্য ব্যক্তির ছবি দেন। ছবিটি কক্সবাজার সদরের ঈদগাহ এলাকার গিয়াস উদ্দিনের। হামিদের আর্থিক নেটওয়ার্ক রহিম উল্লাহ রক্ষণাবেক্ষণ করেন, যার বিকাশ নম্বর (01882918276) জাহেদা ইয়াসমিন নামে এক মহিলার নামে নিবন্ধিত। তার জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর ৭৩৪২৯৯০৮০৬।

    মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে হামিদ প্রথমে জিজ্ঞেস করেন, ‘আমার নম্বর কোথায় পেলেন?’ মাদক ব্যবসার বিষয়টি সামনে আনলে তিনি বলতে থাকেন, ‘তুমি ভুল নম্বরে কল দিয়েছ। এলাকা তল্লাশি করো। কক্সবাজারে আমার মতো ভালো দুজন মানুষ পাবেন না। কে বলেছে, আমি মাদক ব্যবসায়ী? টেকনাফে হামিদ নামে আরেক মাদক ব্যবসায়ী রয়েছে। হয়তো কেউ আপনাকে বিভ্রান্ত করছে। মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে আমার নাম আসবে কেন? কেউ আমাকে শত্রুতা করে ফাঁসিয়ে দিচ্ছে। আমি একজন সাধারণ মানুষ ভাই।’

    মন্তব্য করুন