ভিকারুননিসায় স্বার্থের দ্বন্দ্ব।পরিচালনা পর্ষদের তিন সদস্যের সাথে অধ্যক্ষের বিরোধ
দেশের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ কামরুন নাহার মুকুলের সাথে মীর সাহাবুদ্দিন টিপুর কথোপকথনের একটি অডিও রেকর্ড সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। যদিও সাহাবুদ্দিন টিপু কথোপকথনে স্বীকার করেছেন, তবুও অধ্যক্ষ তা অস্বীকার করেছেন। তিনি সম্পূর্ণ বানোয়াট বলে দাবি করেছেন। ফোন কলের ৪ মিনিট ৩৯ সেকেন্ডের এক পর্যায়ে অধ্যক্ষকে বলতে শোনা গেল, ‘আমি বালিশের নীচে পিস্তল রাখি। কোনো বাচ্চা যদি আমার পিছনে লাগে,আমি কিন্তু ওর পিছনে লাগব। আমি শুধু ভিকারুননিসা না, আমি তাকে দেশছাড়া করব।
অধ্যক্ষ এবং অভিভাবক ফোরামের নেতার মধ্যে কথোপকথন শুনে ভিকারুননিসা-র শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকরা বিব্রত হন। কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন যে এটি ভিকারুননিসার দীর্ঘকালীন খ্যাতি এবং ঐতিহ্যকে আঘাত এসেছে।
কথোপকথনের ফাঁসের পরে জানা গেল, প্রিন্সিপাল কামরুন নাহার মুকুল ভিকারুননিসার পরিচালনা পর্ষদের তিন সদস্যের সাথে তীব্র দ্বন্ধে জড়িয়ে পড়েছেন। আর এর পিছনে ধানমন্ডিতে প্রায় ৬৪ কোটি টাকার একটি প্রতিষ্ঠানের নামে একটি বাড়ি কেনার বিষয়টি রয়েছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে এ বছর প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি ও উন্নয়ন কাজের অর্থ নিয়ে মতবিরোধ।
মাত্র সাত মাস আগে, জানুয়ারিতে, কামরুন নাহার মুকুল কলেজের অধ্যক্ষ হিসাবে ডেপুটেশনটিতে যোগদান করেন। বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা মুকুল আগে মিরপুরের ডুয়ারীপাড়া সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। তদন্ত অনুসারে, ভিকারুননিসা ধানমন্ডি শাখাটি ধানমন্ডির ৬ নম্বর রোডের ৮ নম্বর বাড়িতে অবস্থিত।
২৫ বছর ধরে এ ভাড়া বাড়িতে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হচ্ছে।বিদ্যালয়ের কার্যক্রম ১৪ কাঠা জমির ৭ কাঠা জমিতে নির্মিত একটি ভবনে পরিচালিত হয়। বিল্ডিংয়ের মালিক অনেক আগে ভিকারুননিসা কর্তৃপক্ষকে ভবনটি খালি করার নোটিশ দিয়েছিলেন। তারা নোটিস না মানায় আদালতের দ্বারস্হও হন। পরে পাশের আনোয়ার খান আধুনিক হাসপাতালের মালিকও কর্তৃপক্ষের সাথে ভবনটি বিক্রির বায়নাও করেন। ভিকারুননিসার পরিচালনা পর্ষদের প্রাক্তন সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমানের সময়ে এই ভবনটি কেনার প্রস্তাব করা হয়েছিল। এরপরে কমিটির কয়েকজন সদস্য মালিকের সাথে আলোচনা করে দাম ৫৪ কোটি টাকা নির্ধারণ করেন। এ ছাড়া রেজিস্ট্রি ও অন্যান্য কাজে বাবদ ১০ কোটি টাকা মিলে ৬৪ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়। কমিটির বর্তমান চেয়ারম্যান ও অধ্যক্ষ জমি কেনার বিষয়ে ‘ধীরগতির’ নীতি অনুসরণ করছেন। এতে কমিটির কয়েকজন সদস্য ক্ষুব্ধ হন। একপর্যায়ে কমিটির তিন সদস্য অধ্যক্ষের কাছ থেকে দূরত্ব সৃষ্টি হয়।
সোমবার কথা বলতে গিয়ে অধ্যক্ষ কামরুন নাহার মুকুল বলেন, কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে ধানমন্ডিতে জমি ও ভবন কিনতে সংগঠনকে বাধা দেওয়ার কারণে তাকে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়। জমি কেনার পরে কমিশন নিতে ব্যর্থ হওয়ায় তারা তাঁর নামে বানানো অডিও রেকর্ড ছেড়েছে তারা।
অন্যদিকে গভর্নিং বডির (অভিভাবক-মাধ্যমিক) সদস্য সিদ্দিকী নাসির উদ্দিনের ভাষ্য,এসব ভুয়া কথা। সংস্থাটি জমিটি কিনে নিলে সংস্থার তা থাকবে। না কিনলে নাই। এতে আমাদের কী ? আমরা আরও তিন মাস কমিটিতে আছি। এরপর চলে যাব।
জানা গেছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে তিনটি পৃথক প্রতিষ্ঠান গত এক বছরে ভিকারুননিসায় বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির তদন্ত করছে। পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতর (ডিআইএ), শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর (ইইডি) এবং ঢাকা শিক্ষা বোর্ড বর্তমানে দুর্নীতির বিষয়ে পৃথক তদন্ত চালাচ্ছে। অভিযোগ করা হয়েছে যে সংস্থাটির পরিচালনা পর্ষদের মাধ্যমিক শাখার সদস্য (অভিভাক ফোরামের) সিদ্দিকী নাসির উদ্দিন উন্নয়ন প্রকল্পে কাজ করছেন তবে কাজের বিল-ভাউচার জমা দিচ্ছেন না। গত ৮ এপ্রিল অধ্যক্ষ সিদ্দিকী নাসির উদ্দিনকে ১ কোটি ৫৯ লাখ টাকার বিল-ভাউচার জমা দেওয়ার জন্য চিঠি পাঠান। “প্রকল্প কমিটির আহ্বায়ক হিসাবে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য আপনি বিভিন্ন কিস্তিতে ১ কোটি ৫৯ লাখ টাকা অগ্রিম গ্রহন করেছেন, কিন্তু তিনি সেই অর্থের বিল-ভাউচার সামঞ্জস্য করেননি। তারপরে ১৭ মে অধ্যক্ষ শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরে অভিযোগ করেন।
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অভিভাক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মজিদ সুজন বলেন, চুক্তির কাজের বিল পরিশোধ না করে কমিটির কিছু সদস্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। অর্থ উপার্জনের জন্য তারা কমিটির কয়েকজন সদস্যের সহায়তায় ঈদ-উল-আযহার আগে কলেজ ক্যাম্পাসে কোরবানির পশুর হাট বসানোর জন্য ফখরুদ্দিন বিরিয়ানি হাউস ও ডেকোরেটর ব্যবহার করে। অভিভাকদের আপত্তির কারণে পরে হাট উঠিয়ে দেওয়া হয়।
পাল্টা অভিযোগ: কামরুন নাহার মুকুল অভিযোগ করেছেন যে, পরিচালনা কমিটির সদস্য সিদ্দিকী নাসির উদ্দিন, খোকন এবং ওয়াহিদুজ্জামান মন্টু তাকে প্রথম শ্রেণিতে অবৈধভাবে ভর্তি করার জন্য তাকে চাপ দেন।