বিআরটি প্রকল্পে ১৭ মাসে তিন দুর্ঘটনা।চরম অসাবধানতা, কেউ শোনেনি সতর্কবার্তা
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল বাস র্যাপিড ট্রানজিটের (বিআরটি) পাশে নির্মাণাধীন। বড় অক্ষরে লেখা আছে ‘নিরাপদ না হলে কাজ বন্ধ করুন’। কিন্তু দেশের ব্যস্ততম সড়কে ১০ বছর ধরে চলা বিআরটি প্রকল্পে নিরাপত্তার বিষয়টিকে কখনোই গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। পাইলিং, পিয়ার এবং ভায়াডাক্ট নিরাপত্তা বেড়া ছাড়াই নির্মাণ করা হয়েছে। সোমবার উত্তরায় ক্রেন উল্টে এবং ভায়াডাক্টের বক্স গার্ডার একটি প্রাইভেটকারের ওপর পড়ে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে, সেখানে কোনো নিরাপত্তা বেষ্টনী নেই।
বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) নির্মাণে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না। সরকারি প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিআরটি লিমিটেড প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সফিকুল ইসলাম বলেন, দুর্ঘটনার কারণ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, ক্রেনে কারিগরি ত্রুটি ছিল। সে কারণেই এটি হেলে পড়েছে।
গত ১৭ মাসে বিআরটি প্রকল্পে তিনটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। গত বছরের ১৪ মার্চ বিমানবন্দর স্টেশনের সামনে পিলারের ওপর রাস্তার স্ল্যাব বসানোর লঞ্চারটি ধসে পড়ে। এতে দুই চীনা শ্রমিকসহ চারজন গুরুতর আহত হয়েছেন। এর আগে রাতে আবদুল্লাহপুরে একটি নির্মাণাধীন পিলারের টুপি ধসে পড়ে। সেফটি বেল্ট না থাকায় ট্রাকটি ভেতরে ঢুকলে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
গত বছর টঙ্গীতে বিআরটি ফ্লাইওভারের নিচে ট্রাকটি বেহাল রাস্তার কারণে উল্টে যায়। বহু বছর ধরে ভোগান্তি পোহাতে থাকা বিআরটি নির্মাণে অনিয়মের অভিযোগ তোলেন গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। সড়ক পরিবহন বিভাগ, ঢাকা ও গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ নিরাপত্তা বেষ্টনী দিয়ে নির্মাণ কাজের পরামর্শ দিলেও তা মানা হয়নি। নির্মাণ কাজের কারণে দুর্ঘটনার আশঙ্কায় নিরাপত্তার দাবি জানিয়েছেন সাধারণ যাত্রীরাও। কর্তৃপক্ষ তাতে কর্ণপাত করেনি।
সরেজমিনে গতকাল বিকেলে দেখা যায়, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের বিমানবন্দর মোড়ের মাঝখানে বিআরটি ফ্লাইওভারের র্যাম্প নির্মাণের কাজ চলছে। র্যাম্পের দুই পাশের দেয়াল উঁচু। র্যাম্পে ওঠার পথে বালু, ইট ফেলে রাখা হয়েছে। উত্তরায় এপিবিএন অফিসের সামনে থেকে নির্মাণাধীন ১০ লেনের টঙ্গী সেতু পর্যন্ত সড়কের মাঝখানে ফ্লাইওভারের বক্স গার্ডার বসানো হয়েছে। তার দুপাশে গাড়ি চলছে। শুধু বাঁশ দিয়ে দুপাশে বেড়া দেওয়া। যা মাঝে মাঝে ভেঙ্গে যায়।
গতকাল বিকেলে জসিম উদ্দিন রোডের মোড়ে আরেকটি গার্ডারের ওপর যে ক্রেনটি বক্স গার্ডার তুলছিল সেটি জাপানের কোবে স্টিল লিমিটেডের তৈরি। ক্রেনের স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী, এটি সর্বোচ্চ ৮০ টন ওজন ৪ মিটার বা ১৩.১২ ফুট উচ্চতায় তুলতে পারে। তবে দুর্ঘটনাস্থলে সড়কের মাঝ বরাবর একটির ওপরে সর্বোচ্চ তিনটি গার্ডার বসানো হয়েছে। তাদের সম্মিলিত উচ্চতা প্রায় ৩০ ফুট।
ক্রেনটি তার ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি ভারী গার্ডার তুলছিল নাকি অন্য কোনো কারণে হেলে পড়েছে সে বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক (পিডি) এএসএম ইলিয়াস শাহের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি। পিডি বলেন, বিস্তারিত কারণ খতিয়ে দেখে কথা বলবেন।
প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ জানায়, ক্রেন দিয়ে গার্ডারটি তোলার সময় কোনো নিরাপত্তা বেষ্টনী ছিল না। দুর্ঘটনাস্থল থেকে ২০ গজ পশ্চিমে পথচারী নিজামুল ইসলাম বলেন, ক্রেনটি ব্যস্ত সড়কের মাঝখানে ছিল। গার্ডার তুলছিল। গাড়িটি জসিম উদ্দিন রোড মোড় থেকে আসছিল। গার্ডার উঠানোর সময় হঠাৎ ক্রেনটি ডানদিকে কাত হতে থাকে। একপর্যায়ে গার্ডারটি গাড়ির ওপর পড়ে যায়।
ঢাকায় মেট্রোরেল নির্মাণ সংক্রান্ত অ্যালাইনমেন্টের দুই পাশে নিরাপত্তা বেষ্টনী ছিল। বেড়ার ভিতরে নির্মাণ সরঞ্জাম দিয়ে রাতে ভারী কাজ করা হয়। জাপানের ঋণে মেট্রোরেল নির্মাণের কাজ চলছে। জাইকার নিরাপত্তা শর্ত অনুসরণ করতে হবে। বিআরটির উড়ন্ত অংশের ঠিকাদার চীনা কোম্পানি জিয়াংসু প্রভিন্সিয়াল ট্রান্সপোর্টেশন ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটি আর্থিক সংকটে রয়েছে বলে খোদ প্রকল্প কর্মকর্তাদের অভিযোগ। উপাদান সরবরাহকারী এবং সাব-কন্ট্রাক্টরদের বকেয়া পরিশোধ না করা। নিরাপত্তা একটি উদ্বেগ নয়. এ খাতে বিনিয়োগ করে না।
এ প্রসঙ্গে সফিকুল ইসলাম বলেন, বিআরটির ক্ষেত্রে এটা সম্ভব নয়। দেশের ব্যস্ততম সড়কে নির্মাণাধীন বিআরটি। দিনের তুলনায় রাতে এখানে যানবাহন বেশি। তাই শুধু যেখানে কাজ করা হয় সেখানে বেড়া দিয়ে কাজ করা হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা নিশ্চিত করেছেন যে ক্রেন দিয়ে কাজ করার সময় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের জন্য কোনও প্রকল্পের কর্মী ছিল না। অন্যান্য প্রকল্পের ক্ষেত্রে পতাকাবাহী কর্মীরা ভারী যানবাহনের সময় রাস্তার ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করে। সফিকুল ইসলাম বলেন, গতকাল ক্রেন অপারেশনের সময় কোনো শ্রমিক ছিল কিনা তা দেখা হবে।