বাণীশান্তার কৃষকরা জমি রক্ষায় জীবন দিতে প্রস্তুত।দাকোপে এক অন্যরকম জমায়েত
দুপুর ও বিকেল। পশ্চিম আকাশে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। শীতের মৃদু হাওয়া বইছে। দিগন্ত জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে কুয়াশার কুয়াশা। মাঝখানে ধানের কান জেগে উঠেছে মাঠে। কৃষকের ঘর্মাক্ত স্বপ্নের ফসল বাতাসে দুলছে। কয়েকদিনের মধ্যে মাঠ সোনালি হয়ে যাবে। প্রকৃতি যেন অপরূপ সাজে সেজেছে খুলনার দাকোপ উপজেলার সুন্দরবনের কুলঘেঁষা বাণীশান্তা ইউনিয়নে। আর তিন সপ্তাহ পর পাকা ধানের গন্ধে ভরে উঠবে কৃষকের মন। কিন্তু মঙ্গলবার বাণীশান্তায় কৃষকের মুখ মলিন দেখা গেছে। সোনালী ধান নিয়ে তারা বিরক্ত নয়। তিন ফসলি জমি চিরতরে হারানোর দুশ্চিন্তা বসে আছে ঘরে ঘরে। জীবিকা হারিয়ে উদ্বাস্তু হওয়ার ভয় নিয়ে। গত দেড় বছর ধরে জমি রক্ষার দাবিতে বিক্ষোভ করে আসছেন বাসিন্দারা। হুমকির কথা মাথায় রেখেও ফসল ফলানো হয়েছিল। বাণীশান্তা কৃষি জমি প্রতিরক্ষা কমিটি গঠন করা হয়। মানববন্ধন, জনসভা, মিছিল, সংবাদ সম্মেলন, প্রধানমন্ত্রীকে খোলা চিঠিসহ বিভিন্ন আন্দোলন করেও আশ্বাস মেলেনি। তার পরিবর্তে বালু ফেলার নতুন প্রক্রিয়া শুরু করেছে মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ। বিষয়টি আবারো উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। গতকাল মঙ্গলবার বাণীশান্তা বাজারের কৃষক সমাবেশে কৃষকদের উদ্বেগ ও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। দুপুর থেকেই মিছিল নিয়ে এখানে ছুটে আসেন শত শত নারী-পুরুষ। বাণীশান্ত কৃষিজমি রক্ষা সংগম কমিটি, বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্ট ল সোসাইটি (বেলা), নিভিরা কারি, ব্লাস্ট, টিআইবি, ব্র্যাক, বাপা, আইআরভি, সুজন, এলআরডি এবং বিভেস সুরক্ষা মঞ্চসহ ১৬টি সংগঠন যৌথভাবে এই সমাবেশের আয়োজন করে।
বক্তারা বলেন, দাকোপের পশুর নদীর তীরবর্তী বাণীশান্তার কৃষকরা অনাহারে ভুগছেন। মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ পশু নদী খনন থেকে তাদের তিন ফসলি জমিতে বালু ফেলতে চায়।
এ জন্য কৃষকদের মতামত উপেক্ষা করে সেখানে তিনশ’ একর জমি দখল করেছে জেলা প্রশাসন। আন্দোলনের মুখে ওই জমিতে বালু ফেলা হবে না বলে ঘোষণা দেয় উপজেলা প্রশাসন। এতে এলাকার মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে। তবে সম্প্রতি আবারও বালু ফেলার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সমাবেশ থেকে জানানো হয়, বাণীশান্তার কৃষকরা যে কোনো মূল্যে কৃষিজমি ধ্বংসের ষড়যন্ত্র প্রতিহত করবে। সমাবেশে বক্তারা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হলে দায় প্রশাসন ও বন্দর কর্তৃপক্ষকে নিতে হবে বলেও ঘোষণা দেন। দাবি মানা না হলে সমাবেশে অবস্থান কর্মসূচিসহ কঠোর আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়।
সমাবেশে আসা কৃষকরা বলেন, জমির ফসল ছাড়া জীবন চলবে না। জমি রক্ষায় প্রয়োজনে জীবন দিতেও প্রস্তুত। তিন ফসল নষ্ট হওয়ার আগে বালি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।
দেশের বিশিষ্টজনসহ বিভিন্ন সংগঠন সাধারণ মানুষের এই দাবিকে সমর্থন করছে। স্থানীয় সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউপি চেয়ারম্যানসহ জনপ্রতিনিধিরাও কৃষি জমিতে বালু ফেলার বিরুদ্ধে।
সমাবেশে বক্তব্য রাখেন নাভিরা কারির সমন্বয়ক খুশি কবির, অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (এএলআরডি) নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, হিন্দু উপদেষ্টা কাজল দেবনাথ প্রমুখ। বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ, অর্পিত সম্পত্তি হস্তান্তর আইন বাস্তবায়ন সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি। এ সময় উপস্থিত ছিলেন নাগরিক সমন্বয় সেলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মনিন্দ্র কুমার নাথ, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের কার্যকরী সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, পরিবেশ সংরক্ষণ ফোরামের সভাপতি অ্যাডভোকেট কুদরত-ই-খুদা, সমন্বয়কারী অ্যাডভোকেট বাংলাদেশ লিগ্যাল এ্যাড. সার্ভিস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) খুলনা জেলা অশোক সাহা, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) খুলনা ক্লাস্টার সমন্বয়কারী। ফিরোজ উদ্দিন, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কেন্দ্রীয় নেতা। নূরে আলম শেখ, দাকোপ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মনসুর আলী খান, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান গোরপদ বাছার, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বিনয় কৃষ্ণ রায়, বাণীশান্তা ইউপি চেয়ারম্যান সুদেব কুমার রায় প্রমুখ।
জনসভার আগে গ্রাম ঘুরে, মাঠ, চায়ের দোকান- সবখানেই একই আলোচনা। কৃষক আব্দুল মজিদ জানান, আইলা, সিডোর, আম্পানের মতো ঝড় মোকাবেলা করে তারা বেঁচে আছেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ সত্ত্বেও কৃষকরা বসে নেই। লোনা পানিতেও স্বর্ণ উৎপন্ন হয়। আষাঢ় থেকে পৌষ মাস পর্যন্ত আমন ধান, পৌষ থেকে বৈশাখ মাস পর্যন্ত তরমুজ, বৈশাখ থেকে শ্রাবণ মাস পর্যন্ত আউশ ধানসহ অন্যান্য রবিশস্য বাণীশান্তার চাষের জমিতে চাষ করা হয়। এ জমিতে বালু ফেলা হলে এলাকার অন্তত পাঁচটি গ্রামের মানুষ- বাণীশান্তা, আমতলা, ভোজনখালী, খাজুরা ও ধংমারী ক্ষতিগ্রস্ত হবে।