ভয়াল কাল রাত আজ, গণহত্যা দিবস, রাতে সারাদেশে এক মিনিটের প্রতীকী ব্ল্যাকআউট ২৫ মার্চ
আজ ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালের আজকের এই দিনের শেষে বাঙালি জাতির জীবনে এলো এক ভয়াবহ কালরাত। ১৯৭১ সালের এই দিনে মধ্যরাতে অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের পূর্ব পরিকল্পিত অপারেশন মোতাবেক বাঙালি জাতির কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করার জঘন্য লক্ষ্য নিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সার্চ লাইট ব্লুপ্রিন্ট। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী পরিচালিত অপারেশন সার্চলাইটের নাম ছিল অপারেশন সার্চলাইট।
দুই পাকিস্তানি সামরিক অফিসার, মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা এবং মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী, অপারেশন সার্চলাইট অভিযান পরিচালনা করেন। নির্দেশের কোনো লিখিত রেকর্ড রাখা হয়নি। গণহত্যার পুরো আদেশটি মৌখিকভাবে ফরমেশন কমান্ডার বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে জানানো হয়েছিল। অনেক পরে ২০১২ সালে, মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা তার আত্মজীবনী প্রকাশ করেন যার শিরোনাম ‘এ স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ওন কান্ট্রি’। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস দ্বারা প্রকাশিত আত্মজীবনী প্রথমবারের মতো অপারেশন সার্চলাইট সম্পর্কে কিছু তথ্য প্রকাশ করেছে।
১৯৭১ সালে কীভাবে অপারেশন সার্চলাইট পরিকল্পনা করা হয়েছিল সে সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দিয়ে রাজা লিখেছেন, ১৭ মার্চ, সকাল ১০ টার দিকে। টিক্কা খান আমাকে এবং মেজর জেনারেল ফরমানকে কমান্ড হাউসে তার সাথে দেখা করার জন্য বলেন। খবর পেয়ে আমরা দুজনেই টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করি। গিয়ে দেখি, জেনারেল আবদুল হামিদ খানও আছেন। টিক্কা খান আমাদের বলেছিলেন যে রাষ্ট্রপতির সাথে শেখ মুজিবের পুনর্মিলনের আলোচনা ইতিবাচক দিকে এগুচ্ছে না। রাষ্ট্রপতি চান যে আমরা সামরিক অভিযানের জন্য প্রস্তুত হই এবং সেই অনুযায়ী একটি পরিকল্পনা করি। এছাড়া আমরা অন্য কোন মৌখিক বা লিখিত নির্দেশনা পাইনি। আমাদের বলা হয়েছিল যে ১৮ মার্চ বিকেলে আমাদের দুজনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা করে পরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে হবে। পরদিন সকালে খাদিম হোসেন রাজা রাও ফরমান আলীর সাথে তার অফিসে বসেন। তারা গণহত্যার এই অভিযানের নাম দিয়েছে অপারেশন সার্চলাইট।
আমেরিকান সাংবাদিক রবার্ট পেইন ২৫শে মার্চ রাত সম্পর্কে লিখেছেন, “সেই রাতে ৭০০০ মানুষ নিহত হয়েছিল, আরো ৩০০০ মানুষকে গ্রেফতার করা হয়েছিল।” এর পরে, সৈন্যরা সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়াতে থাকে। বাড়িঘর ও দোকানপাট পুড়তে থাকে। লুটপাট ও ধ্বংসলীলা তাদের নেশায় পরিণত হয়। রাস্তায় পড়ে থাকা লাশগুলো কাক ও শেয়ালের খাবারে পরিণত হয়েছে। সারা বাংলাদেশ শকুনদের আড্ডায় পরিণত হয়েছে।
খোদ পাকিস্তান সরকারের প্রকাশিত নথিতেও এই পাইকারি গণহত্যার স্বীকৃতি রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সরকার কর্তৃক প্রকাশিত পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্কটের উপর শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, “১৯৭১ সালের ১লা মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ রাত পর্যন্ত এক লাখেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারায়।”
সচেতন নাগরিককে নির্বিচারে হত্যা করা। এদিন দুপুরের পর থেকে ঢাকাসহ সারাদেশে থমথমে অবস্থা বিরাজ করতে থাকে। সকাল থেকেই সেনা কর্মকর্তাদের তৎপরতা দৃশ্যমান ছিল। তারা হেলিকপ্টারে করে দেশের বিভিন্ন সেনানিবাস পরিদর্শন করে বিকেলে ঢাকা সেনানিবাসে ফিরে আসেন।
ঢাকার ইপিআরের সদর দপ্তর পিলখানায় অবস্থানরত ২২তম বেলুচ রেজিমেন্টকে পিলখানার বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিতে দেখা যায়। পাকিস্তানি সেনারা মধ্যরাতে পিলখানা, রাজারবাগ, নীলক্ষেত আক্রমণ করে। হানাদার বাহিনী ট্যাংক ও মর্টার দিয়ে নীলক্ষেতসহ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা দখল করে। সেনাবাহিনীর মেশিনগানের গুলি, ট্যাঙ্ক-মর্টার গোলা এবং আগুনের লেলিহান শিখা শহরের রাতকে ভয়ঙ্কর করে তুলেছিল।
পাকিস্তানি হায়েনাদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি রোকেয়া হলের শিক্ষার্থীরা। ডাঃ গোবিন্দ চন্দ্র দেব ও জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, ডাঃ মনিরুজ্জামানসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ৯ শিক্ষককে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।