বড় বাঁচা উপকূল
ক্ষণে ক্ষণে গতি পাল্টেছে। ধাপে ধাপে ক্ষমতা বাড়িয়েছে ‘মওকা’। ঘূর্ণিঝড়ের শক্তিশালী শক্তি দেখে বিশ্বের সব আবহাওয়া সংস্থার পূর্বাভাসে উচ্চ ঝুঁকির তালিকায় ছিল বাংলাদেশ। কেউ কেউ একে সুপার সাইক্লোনও বলেছিল। আবহাওয়া অধিদপ্তর কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরকে ১০ নম্বর দুর্যোগ সংকেত দেখাতে বলেছে। এমন দৃশ্যে উপকূলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। আতঙ্কে মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটে যায়। ঘূর্ণিঝড়ের সম্মুখভাগ গত রোববার গভীর রাতে সেন্টমার্টিন স্পর্শ করে। রাতে বৃষ্টি হলেও সকালের আলো এলেই সব ভয় উধাও হয়ে যায়। সেন্ট মার্টিন থেকে, মোকার মূল ফোকাস, চোখ ফিরে মিয়ানমারের দিকে। বাংলাদেশকে পেছনে ফেলে মিয়ানমারে আঘাত হেনেছে ঘূর্ণিঝড়।
এটি কক্সবাজার উপকূল স্পর্শ করলেও মওকার মূল ধাক্কাটি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের ওপর দিয়ে গেছে। শক্তিশালী এই ঝড়ের পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া না গেলেও দেশে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির আশঙ্কা করা হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড়টি রাখাইন রাজ্যের রাজধানী সিত্তওয়ের কেন্দ্রের উপর দিয়ে যাওয়ার কারণে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২০৯ কিলোমিটার।
গত রোববার রাতে বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম করে মওকা। সেন্ট মার্টিনের পথে তাণ্ডব অব্যাহত; পেছনে ফেলে যাওয়া দাগ। সেন্ট মার্টিনে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৪৭ কিলোমিটার। বড় বিপদ থেকে রক্ষা পেলেও প্রবাল দ্বীপটি এখন ধ্বংসস্তূপে। টেকনাফ ও শাহপরী দ্বীপেও মওকা পড়েছে। প্রবল ঘূর্ণিঝড় ঘনিয়ে আসায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ৮ নম্বর উচ্চ-দুর্যোগ সংকেত দেখিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত চট্টগ্রামে বাতাসের তেমন প্রভাব পড়েনি। টেকনাফ ও সেন্টমার্টিন ছাড়া অন্য কোনো এলাকা থেকে মামলার খবর পাওয়া যায়নি। ঢাকাও ছিল বৃষ্টিহীন। মওকা চট্টগ্রামে সরাসরি বিপদ না ঘটালেও এলএনজি সরবরাহ বন্ধ থাকায় জনজীবন বিপর্যস্ত। বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ থাকায় লোডশেডিং বেড়েছে। বাড়িতে গ্যাস না থাকায় রান্না বন্ধ হয়ে যায়।
এদিকে সোমবার থেকে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিয়মিত ফ্লাইট চলাচল শুরু হবে। বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সোমবার সকালে চট্টগ্রাম বন্দরের মূল জেটি ও আউটার অ্যাঙ্করেজ থেকে সাগরে পাঠানো জাহাজগুলো আবার জেটি ও আউটার অ্যাঙ্করেজে জড়ো হবে।
মওকার তাণ্ডবে কক্সবাজারে ১০ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন। বিধ্বস্ত হয়েছে দুই হাজার বাড়ি।
জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শাহীন ইমরান জানান, ঘূর্ণিঝড়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে টেকনাফ-সেন্টমার্টিন দ্বীপের। শুধুমাত্র সেন্ট মার্টিন দ্বীপেই ১,২০০টি বাড়ি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মাহফুজুল ইসলাম জানান, সেন্টমার্টিনে ১০ জন আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে এক নারী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। প্রধান সড়ক ও আঞ্চলিক সড়কগুলো দ্রুত ভেঙে পড়া গাছ সরিয়ে সংস্কার করা হচ্ছে।
সেন্টমার্টিন ও টেকনাফ উপকূলে চিংড়ির খাঁচা, লবণ ক্ষেত ও পানের বার্জের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। টেকনাফ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নুরুল আলম বলেন, কক্সবাজারে এবার লবণের বাম্পার ফলন হয়েছে। ৬০ হাজার একর জমিতে ৩৫ হাজার টন লবণ উৎপাদিত হয়েছে। তবে ঘূর্ণিঝড়ের কারণে অনেকেই মাঠে লবণ তুলতে পারেননি। মাছের ঘের ও লবণের ক্ষেতও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এদিকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান গতকাল রাতে জানান, দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতির তথ্য এখনো আসেনি। তিনি বলেন, পাঁচ বছরে যত দুর্যোগ মোকাবিলা করেছি, তার মধ্যে এবারের ব্যবস্থাপনা ছিল সেরা।
এদিকে ঘূর্ণিঝড় চলে গেলেও টানা বর্ষণে ভূমিধসের আশঙ্কায় টেকনাফ ও উখিয়ার রোহিঙ্গারা আতঙ্কে রয়েছে। পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারী লোকজনকে পুনরায় আশ্রয়কেন্দ্রে ভর্তি করা হচ্ছে।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. কামরুজ্জামান জানান, কোনো প্রাণহানি না হলেও ঘূর্ণিঝড়ে অনেক জায়গায় বাড়িঘর ও দোকানপাট বিধ্বস্ত হয়েছে।
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাশার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান চৌধুরী জানান, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে টানা বৃষ্টির কারণে পাহাড়ের মাটি আলগা হয়ে যাচ্ছে। এতে ভূমিধসের ঝুঁকি বাড়ে। চট্টগ্রামে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারীদের নিরাপদে সরে যেতে আমরা মাইকিং করছি।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, ঘূর্ণিঝড় মওকা বাংলাদেশের ভূখণ্ড ছেড়েছে। সংস্থাটির পরিচালক আজিজুর রহমান জানান, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরে ১০ নম্বর বিপদ সংকেত নামিয়ে ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত দেখানো হয়েছে। ঝড় চলে গেছে, মানুষ তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারে। তবে ঝড় চলে গেলেও আগামী কয়েকদিন বৃষ্টি হতে পারে। পাশাপাশি আগামী ২৪ ঘণ্টায় সাগর উত্তাল থাকায় মাছ ধরার জন্য সাগরে না যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। তিনি আশা করেন যে মঙ্গলবারের মধ্যে সমস্ত সতর্কতা সংকেত হ্রাস পাবে।
মায়ানমারে বিপর্যয়
রাখাইন রাজ্যের অনেক এলাকা, যেখানে ঘূর্ণিঝড় সবচেয়ে বেশি আঘাত হানে, সেখান থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। সিত্তওয়ের বাসিন্দাদের কাছে পি দ্বারা পৌঁছানো যায়নি।