বিবিধ

বড় ঝুঁকিতে রুপালি ইলিশ

শুক্রবার রাজধানীর মোহাম্মদপুরের টাউন হল মার্কেটে ইলিশ কিনতে গিয়েছিলেন বেসরকারি চাকরিজীবী আজিজুর রহমান। দরকষাকষিতে বিক্রেতার সাথে বনাতে না পেরে তিনি খালি হাতে ফিরে আসেন। আজিজুর জানান, বিক্রেতা ১৫০০ থেকে এক হাজার ৭০০ টাকা নিচ্ছেন। ৭০০ থেকে ৯০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ১ হাজার থেকে ১ হাজার ১০০ টাকা।

সরবরাহ কম থাকায় পিক মৌসুমে ইলিশের দাম বেশি। বর্ষার শুরু থেকেই এই আতঙ্ক চলছে। বৃষ্টি বাড়লে ইলিশ ফিরবে বলে আশার কথা শুনেছিলেন বিশেষজ্ঞরা। তবে টানা তিন সপ্তাহের টানা বর্ষণে জালে কাঙ্খিত রূপালি মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে, ১৩ আগস্ট পটুয়াখালীর পায়রা বন্দরের শেষ বয়ায় জেলে মিজান মাঝির জালে ৯৬ মণ ইলিশ ধরা পড়ে। এর এক সপ্তাহ পর কয়েকটি ট্রলার বড় বড় শোল দেখতে পায়। তবে বেশিরভাগই গভীর সমুদ্রে। দেশে ইলিশের প্রধান সরবরাহ আসে নদী-সাগরের মোহনা থেকে, এর কোনো সুখবর নেই। সাগর নয়, যে নদীতে মাছের ইলিশের স্বাদের জন্য এত বিখ্যাত, সেখানকার অধিকাংশ জেলে মলিন মুখে ফিরছেন।

এমন পরিস্থিতিতে বরিশালে চলছে রুপালি মাছের সাম্রাজ্য। ৩৩ বছর ধরে ব্যবসা করে আসা বরিশাল নগরীর রিয়া মতস্য আড়তঘর, পোর্ট রোড মোকামের মালিক নাসির উদ্দিন মাছ ধরা শেষ হলেও আশানুরূপ ইলিশ দেখতে না পেয়ে হতাশ। তিনি জানান, গত তিন বছরে ভরা মৌসুমে সাতশ থেকে ৯শ গ্রামের ইলিশ ছিল এক হাজার টাকার নিচে। কিন্তু গত বুধবার একই মাছের পাইকারি দাম ছিল এক হাজার ৮০০ টাকা। তিনি বলেন, দু-একটি জালে ইলিশ ধরলেও অধিকাংশ জেলে হতাশ।

তাই ভোজনরসিক বাঙালির প্রাণপ্রিয় ইলিশ হারিয়ে যাচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জেলে, ট্রলার মালিক, ব্যবসায়ী, ব্যবসায়ী ও মৎস্য বিশেষজ্ঞদের কথোপকথনের সারমর্ম হলো, নানা প্রতিকূলতার কারণে ইলিশ বড় ঝুঁকিতে রয়েছে।

মোহনায় নৌ সঙ্কট, গতিপথ পরিবর্তন

ইলিশ সামুদ্রিক মাছ। প্রজননের জন্য নদীতে আসে। সমুদ্র থেকে ইলিশ নদীতে প্রবেশের সময় মোহনায় কমপক্ষে ৩৩ ফুট পানির গভীরতা প্রয়োজন। সংশ্লিষ্টরা জানান, দক্ষিণাঞ্চলে ছয়টি মোহনা রয়েছে।৫ থেকে ১০ কিলোমিটার প্রশস্ত এই মোহনায় পলি জমে এখন নাব্য সংকট। মোহনার মাঝখানে গভীরতা একটু বেশি হলেও দুই পাশেই ভাটা নেমে আসে ৮-৯ ফুট।

ভোলা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোল্লা এমদাদুল্লাহ জানান, দক্ষিণাঞ্চলের ৭০ শতাংশ ইলিশ আসে মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদী থেকে। উভয় নদীর সমুদ্রের উৎস চরফ্যাশনের ঢালু মোহনা। এর এক প্রান্ত পটুয়াখালীর সোনারচর; অন্যদিকে চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ ৬০ কিলোমিটার প্রশস্ত। বর্ষায় পানি দেখা গেলেও বাস্তবে গভীরতা কম। ভাটার সময় তা তিন মিটার পর্যন্ত নেমে যায়। ভোলার মোহনা থেকে ইলিশা ঘাট পর্যন্ত ১৩০টি ডুব। এসব কারণে আগের মতো ধলচর মোহনা হয়ে মেঘনা ও তেঁতুলিয়ায় ইলিশ আসছে না। কারণ ইলিশের বৈশিষ্ট্য হলো এরা কখনো স্থির থাকে না। পথে বাধা হলে পথ বদলান।

মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আনিচুর রহমান তালুকদার জানান, মোহনায় নৌকা সংকটের বিষয়ে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হয়েছে। খনন না করলে ইলিশ সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হবে।

এ ছাড়া মেঘনা থেকে পদ্মা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকায় দূষণ বেড়েছে। নদীতে মাছের প্রয়োজনীয় জৈব খাদ্য কমে গেছে। মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, গত চার বছরে খাদ্য সরবরাহ কমে যাওয়ার হার ৬ শতাংশ। দূষণের কারণে নদীতে আসছে না ইলিশ; এলেও দ্রুত চলে যায়।

নদী কেন্দ্র চাঁদপুরের মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আশরাফুল আলম বলেন, ইলিশের খাদ্যের ৪২ শতাংশই শৈবাল। এর পরে রয়েছে বালি বা ধ্বংসাবশেষ, ৩৬ শতাংশ। বিভিন্ন শিল্প বর্জ্য ইলিশের জলজ পরিবেশ নষ্ট করছে।

সংস্থার এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৮ সালে পদ্মা নদীর পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন বা ডিওর গড় মান ছিল ৮.৭০, ২০২২ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৫.৪১

মৎস্য অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, মৌসুমের প্রথম মাসে জুলাই মাসে ১৩,৩১০,৫০৫ টন ইলিশ আহরণ হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ১৫,১১,৮৬০ টন। জুলাই মাসে বরিশালের বিভিন্ন স্থানে ইলিশ কেনা-বেচা হয়েছে মাত্র ৮৭৪ টন, যা গত বছর এই সময়ে ছিল ২ হাজার ৯৩৭ টন।