প্রাথমিকে এক শিফট চালু নিয়ে বিতর্ক
আগে-পরে চিন্তা না করে হঠাৎ করেই দেশের সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এক শিফট চালু করার নির্দেশ দিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। গত ৪ জানুয়ারি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের এ আদেশ দেওয়া হয়। এ আদেশের পর কর্মকর্তারা বিপাকে পড়েন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাস্তবে এ আদেশ কার্যকর করা কঠিন। সব স্কুলে এক শিফট করার জন্য আরও শিক্ষক প্রয়োজন। অতিরিক্ত শ্রেণীকক্ষও প্রয়োজন হবে। অন্যান্য সমস্যা আছে। তবে এ নিয়ে মুখ খুলতে চান না কেউই।
ওই আদেশে প্রয়োজনে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কম শিক্ষার্থীকে পার্শ্ববর্তী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে একীভূত করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তবে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তারা বলছেন, এ ধরনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা খুবই কঠিন। ছোট বাচ্চারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে। প্রাক-প্রাথমিকের খুদেরাও। এক কিলোমিটার দূরের কোনো স্থানে গিয়ে প্রতিদিন ক্লাস করা তাদের জন্য বাস্তবসম্মত নয়। এই সিদ্ধান্তে ঝরে পড়ার হার বাড়বে। সামাজিক নিরাপত্তার অভাবে মেয়েদের পক্ষে দূরের স্কুলে যাওয়া সবসময় সম্ভব হবে না। এতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছাত্রীর সংখ্যাও কমতে পারে। এতে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যার ভারসাম্য নষ্ট হবে। এ ছাড়া চর, হাওর-বাঁওড়ের মতো দুর্গম ও পাহাড়ি এলাকায় এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা প্রায় অসম্ভব। দুটি পৃথক বিদ্যালয় একীভূত হলে যে বিদ্যালয়ে ক্লাস হবে না, সেই বিদ্যালয়ের জমি, ভবন, পুকুরসহ অন্যান্য সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ কীভাবে হবে- এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই।
যদিও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর উভয় বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ভাগ করে নেওয়ার পরামর্শ দেয়, একটি বিদ্যালয়ে প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি এবং অন্যটিতে তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
সরকারি চাকরিতে থাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকরাও এ বিষয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে পারছেন না। তবে মন্ত্রণালয়ের এ সিদ্ধান্তে তারা সন্তুষ্ট নয়। গত ৪ জানুয়ারি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের নির্দেশনা মাঠপর্যায়ে পৌঁছার পর শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এ বিষয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।
বর্তমানে সারাদেশে ৬৫ হাজার ৫৫৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। তাদের মধ্যে ১ কোটি ৪২ লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। প্রায় ৩৫০,০০০ শিক্ষক আছে। ৬৫,০০০ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৯০% ডাবল শিফট স্কুল। এ সংখ্যা ৫৫ হাজারের বেশি। একক শিফট স্কুলে, ক্লাস শুরু হয় সকাল ৯টায় এবং শেষ হয় ৩:৩০। আর দুই শিফটের স্কুলে প্রথম শিফট সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা, সমাবেশ ও পিটি দুপুর ১২টা থেকে ১২.৩০ পর্যন্ত এবং দ্বিতীয় শিফট দুপুর ১২.৩০ থেকে বিকেল ৪.৩০ পর্যন্ত। ঢাকা শহরের ক্ষেত্রে (শীতকালীন) ডাবল শিফট স্কুলে সকাল ৮.৩০ থেকে ১১.৩০ পর্যন্ত, দ্বিতীয় শিফটে সকাল ১১.৩০ থেকে ৩.৩০ পর্যন্ত পড়ানো হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব (বর্তমানে জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব) ড. আমিনুল ইসলামের আগ্রহে সব স্কুলে এক শিফট চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্প্রতি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের সংখ্যা, দূরত্ব, স্থানান্তর ইত্যাদির ভারসাম্যহীনতার কথা বিবেচনা করে কিছু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটি করার জন্য মন্ত্রণালয়ের যুক্তি হল কম শিক্ষার্থী, বেশি শিক্ষক, কম শিক্ষক এবং বেশি ছাত্র- এ ধরনের ভারসাম্যহীনতা কোথাও না কোথাও বিদ্যমান। আশেপাশের স্কুলগুলোকে একীভূত করা গেলে শিক্ষার্থীদের শেখার সময় বেশি থাকবে।
মন্ত্রণালয়ের স্কুল শাখা সূত্রে জানা গেছে, যেখানে দুই শিফটে শেখার সময় কম, যেখানে শিক্ষার্থী বেশি সেখানে শিফট চালু করতে হবে। ওই সব স্কুলের শিফটগুলো একত্রিত করা হয়েছে। এখন সেসব বিদ্যালয়ে কোনো শিফট নেই।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের জারি করা নির্দেশনায় বলা হয়েছে, যেসব বিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত সংখ্যক ব্যবহারযোগ্য শ্রেণীকক্ষ ও শিক্ষক রয়েছে তাদের অবিলম্বে শিফট শুরু করতে হবে। যে সকল বিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত শিক্ষক বা শ্রেণীকক্ষ নেই বা উভয়েরই ঘাটতি রয়েছে, সেক্ষেত্রে সর্বোচ্চ এক কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে অবস্থিত দুটি বিদ্যালয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে একটি শিফটে দুটি বিদ্যালয়ে পাঠদান পরিচালনা করতে হবে। এই বিভাগটি একটি বিদ্যালয়ে প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত এবং অন্য বিদ্যালয়ে III থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদানের ব্যবস্থা করতে পারে।
রোববারের মধ্যে শিফট শুরুর সম্ভাব্যতা যাচাই ও পর্যালোচনা করে বিস্তারিত তথ্যসহ প্রতিবেদন পাঠাতে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।