প্রথম দিনেই প্রাণ-হিল্লোলে মুখর বইমেলা ।অমর একুশে বইমেলা
মাঘের এই শেষার্ধে শীত তার পাতা কুড়াচ্ছে। রাজধানী ঢাকার আকাশও গতকাল ছিল কুয়াশাচ্ছন্ন। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, বাংলা একাডেমি ও সংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এসবের প্রভাব পড়েনি বলে মনে হয়। সন্ধ্যার পর থেকে এলাকাটি মানুষের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে। কারণ, কিছুক্ষণ আগে বাঙালির প্রাণের বিখ্যাত অমর একুশে গ্রন্থমেলার পর্দা উঠেছিল। মূলত, এটি ছিল প্রকাশক, লেখক ও পাঠকদের উত্তেজনার বহিঃপ্রকাশ কারণ তারা মহামারীর কারণে দুই বছরের কষ্টের পর ভাষার মাস ফেব্রুয়ারির প্রথম দিনে মেলা শুরু করতে পারে।
বিকেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণের মূল মঞ্চে ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত হয়ে মেলার উদ্বোধন করেন। এ ছাড়া বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত সাতটি বিশেষ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী ১৫ জন কবি, লেখক ও গবেষককে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার-২০২২ প্রদান করেন। মহামারী পরিস্থিতির কারণে গত তিন বছর ধরে অমর একুশে এই মেলার উদ্বোধন করতে বঙ্গবন্ধুকন্যা ব্যক্তিগতভাবে আসতে পারেননি। তাই এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে উচ্ছ্বসিত প্রধানমন্ত্রী নিজেই। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন তার ছোট বোন শেখ রেহানাও। মেলার উদ্বোধন শেষে অতিথিদের নিয়ে একাডেমি প্রাঙ্গণে বিভিন্ন স্টল ঘুরে দেখেন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। প্রধানমন্ত্রীর বিদায়ের পর জনসাধারণের জন্য মেলার গেট খুলে দেওয়া হয়।
এই বইমেলার শুরু থেকেই মানুষের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ লক্ষ্য করা গেছে। সন্ধ্যার আগেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের রমনা কালীমন্দিরের প্রধান ফটক জ্যাম হয়ে যায় পাঠকদের ভিড়ে। সব বয়সের নারী-পুরুষ দল বেঁধে আসেন প্রাণের মেলায়। এ সময় লেখকরা তাদের নতুন বই পাঠকদের হাতে তুলে দিয়েছেন। আর দর্শক-পাঠকরা স্টল ঘুরে দেখেন তাদের প্রিয় লেখকের বই। এবার করোনা স্বাস্থ্যবিধির কোনো কঠোরতা নেই। তাই মেলার মাঠে সবাই প্রাণবন্ত।
মেলা পরিদর্শনে আসা মিরপুর বাংলা কলেজের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী তামিম জানান, করোনার দুই বছরের ঐতিহ্য ধরে রাখতে মেলার আয়োজন করা হয়েছে। লকডাউন, পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা- সব মিলিয়ে একটা আতঙ্ক ছিল সবার মধ্যে। অনেক লেখকের বই প্রকাশিত হলেও তিনি মেলায় আসেননি। কিন্তু এবার পরিস্থিতি সেরকম নয়। প্রথম দিনেই আমরা বন্ধু হিসেবে একসাথে এসেছি। স্টল থেকে স্টলে নতুন বই দেখছি। লেখক কোনো প্রকাশনায় উপস্থিত থাকলে ছবি তোলা।
এ বছর বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রায় ১১ লাখ ৫০ হাজার বর্গফুট জায়গায় মেলা বসে। ৬০১টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে মোট ৯০১টি স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। মাসব্যাপী এ মেলার প্রতিপাদ্য ‘বই পড়ি, দেশ গড়ি, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’। এবার একাডেমি ও উদ্যানের দুই অংশেই বসানো হয়েছে ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রযুক্তির ডিজিটাল স্ক্রিন। স্টল ব্যবস্থাসহ মেলা সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য রয়েছে। তবে মেলার প্রথম দিনে স্টল বসাতে পারেননি অনেক প্রকাশক। আয়োজক ও অংশগ্রহণকারী প্রকাশকরা জানান, কোনো বছরেই মেলার প্রথম দিনে স্টল পুরোপুরি চালু হয় না। প্রথম দুই-চার দিন স্টল বসাতে ব্যস্ত প্রকাশকরা। প্রথম দুই-তিন দিন পর মেলার মেজাজ তৈরি হয়। ঘাসফরিং পাবলিশিং হাউসের ব্যবস্থাপক রত্না দাস বলেন, বই সংগ্রহ শেষ হলেও রং করা ও অন্যান্য কাজের জন্য প্রথম দিনে উঠতে পারিনি। আগামী প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ওসমান গণি জানান, মেলার প্রথম দিন থেকেই পাঠকদের উপস্থিতি ভালো। তবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্টল বসাতে পারেননি অনেকেই।
অন্দরপ্রকাশের মালিক মাজহারুল ইসলাম বলেন, শুরুটা ভালো হয়েছে। এবারের বইমেলা আবার আগের চরিত্রে ফিরছে। আশা করছি, এবার জমে উঠবে। তবে কাগজের দাম দ্বিগুণ হওয়ায় বইয়ের দাম কিছুটা বেড়েছে। আমরা দামও সাধ্যের মধ্যে রেখেছি। এটি পাঠকদের খুব বেশি প্রভাবিত করবে না।
মেলা মাঠে কথা হয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদের সঙ্গে। তিনি বলেন, প্রথম দিনেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিভিন্ন স্টলে দর্শনার্থী ও পাঠকদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। কিন্তু প্রথম দিন যতটা আয়োজন করা উচিত ছিল, তা হয়নি। চারিদিকে আবর্জনা।
ছুটির দিন (শুক্র ও শনিবার) ছাড়া প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত মেলা খোলা থাকবে। রাত সাড়ে ৮টার পর কেউ মেলায় প্রবেশ করতে পারবে না। ছুটির দিনে সকাল ১১টা থেকে মেলা শুরু হবে। ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে মেলার দরজা খুলবে সকাল ৮টায়; রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা থাকবে।
প্রতি শুক্র ও শনিবার মেলায় সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত থাকবে ‘শিশু প্রহর’। প্রতিদিন বিকেল ৪টায় বইমেলার মূল মঞ্চে থাকবে আলোচনা সভা ও সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।