• বাংলা
  • English
  • বিবিধ

    পুকুর ভরাট করে। সরকারি অফিস, সুউচ্চ ভবন

    আশির দশকে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর এলাকায় গেলে মন প্রফুল্ল আর চোখে প্রশান্তি ধরা দেয়। ছোট-বড় অন্তত ১০টি জলাশয় ছিল। নগর উন্নয়ন ও সরকারি বহুতল ভবনের কারণে সাতটি পুকুর ইতিমধ্যেই ‘নিখোঁজ’ হয়ে গেছে। শুধুমাত্র ইউজিসি ভবন, বেতার ভবন এবং শেরেবাংলা বয়েজ স্কুলের তিনটি জলাধার টিকে থাকলেও সেগুলো দখল ও দূষিত হচ্ছে। পশ্চিম আগারগাঁওয়ে ইউজিসি ভবনের পাশের পুকুরের ওপর সারি সারি চা ঘর, দোকান আছে। দোকানের প্রতিদিনের আবর্জনা ওই পুকুরে জমা হচ্ছে। কেউ পুকুর ভরা অংশে মিষ্টি কুমড়ার গাছ লাগিয়েছে।

    একই অবস্থা শেরেবাংলা নগর বালক বিদ্যালয়ের পশ্চিম পাশের পুকুরেরও। সড়ক উন্নয়নের বর্জ্য একদিকে পড়ে পুকুরের কিছু অংশ ভরাট হয়ে গেছে। বাকি পুকুরে কিছু পানি দেখা যায়। তবে ওই পুকুর রক্ষায় কারও কোনো আগ্রহ বা উদ্যোগ নেই। এভাবেই রাজধানী থেকে একের পর এক পুকুর দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে।

    মৎস্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৮৫ সালে ঢাকায় পুকুর-জলাশয়-খাল ছিল দুই হাজার। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) গবেষণা বলছে, রাজধানীতে বর্তমানে ২৪টি পুকুর রয়েছে। ফায়ার সার্ভিস বলছে, ২০১৮ সালে ঢাকায় ১০০টি পুকুর থাকলেও এখন ২৯টি। তবে রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশন তাদের এলাকায় কতটি সরকারি-বেসরকারি পুকুর আছে তা জানাতে পারেনি।

    বিশ্লেষকরা বলছেন, উন্নয়নের নামে বিভিন্ন কোম্পানি সরকারি মালিকানাধীন পুকুর ভরাট করে সুউচ্চ অফিস ভবন নির্মাণ করছে। জমির দাম বৃদ্ধির কারণে কয়েক দশকের ব্যবধানে রাজধানীর বেসরকারি পুকুরগুলোতে গড়ে উঠেছে ভবন ও শিল্প-কারখানা। ক্রমবর্ধমান নগরায়নের ফলে একের পর এক পুকুর ভরাট হয়ে যাচ্ছে। কেউ পুকুর পাড়ে ভবন বানিয়ে চড়া দামে ফ্ল্যাট বিক্রি করেছেন, কেউ গড়েছেন ব্যবসা। এভাবেই বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে রাজধানী। জলাধার রক্ষায় আইন থাকলেও সেগুলোর প্রয়োগ নেই।

    শাহবাগে দুটি বড় পুকুর ছিল, যার একটি ভরাট করা হয়েছে আজিজ সুপার মার্কেটে এবং অন্যটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু ও জিয়া হলের জন্য ভরাট করা হয়েছে। আজিজ সুপার মার্কেটের পশ্চিম পাশে একটি পুকুরও ছিল। সেখানে বিদ্যুৎ বিভাগের একটি পাওয়ার হাউস নির্মাণ করা হয়েছে। নগরীর শান্তিনগরে পীরসাহেবের গলিতে বড় পুকুরটি চারদিক থেকে ভরাট হয়ে এখন ছোট পুকুরে পরিণত হয়েছে। বসুন্ধরা শপিংমলের পাশের পুকুর পানিতে ভরে গেছে। জিগাতলা, রায়েরবাজার এলাকায় ছোট ছোট পুকুর ছিল। এখন তাদের ওপর উঁচু ভবনগুলো দাঁড়িয়ে আছে। বাসাবো, খিলগাঁও, রাজারবাগ এলাকার অনেক পুকুর সরকার ভরাট করে দিয়েছে।

    রাজারবাগ পুলিশ লাইনের পুকুর, কমলাপুর রেলস্টেশনের পূর্বে রেলওয়ে ঝিল, আহমেদবাগ এলাকার ঝিলের নাম মানচিত্র থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। মতিঝিল বাংলাদেশ ব্যাংকের পেছনের জলাশয়ও দিন দিন সংকুচিত হচ্ছে। পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী সিক্কাটুলী পুকুরও হুমকির মুখে। গেন্ডারিয়ার ডিআইটি পুকুর দখলের চেষ্টা করছেন স্থানীয় ৪৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শাহানা আক্তার ও তার বাবা সাবেক কাউন্সিলর সহিদ। সম্প্রতি গাবতলীতে বিএডিসি এবং কুড়িলে বাংলাদেশ রেলওয়ে জলাধার ভরাটের উদ্যোগ নিয়েছে। তবে এসব রক্ষায় রাজউক ও সিটি করপোরেশন কোনো জোরালো ব্যবস্থা নেয়নি।

    জানা গেছে, ১০ বছর আগে যাত্রাবাড়ীর মীরহাজিরবাগে বাগিচা মসজিদের পাশে একটি বিশাল পুকুর ছিল। এখন সেখানে গিয়ে পুকুরটির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া কঠিন। পুকুর ঘিরে উঁচু টিনের বেড়া দিয়ে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে ঢালাই কারখানা। তবে কারখানার কয়েক গজ নিচে ফাঁকা জায়গাটি দেখে বোঝা যায়, কয়েকদিন আগেও জায়গাটি ছিল জলাভূমি। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাগিচা মসজিদের আশপাশের দোকানসহ পুকুরের মালিক যাত্রাবাড়ী ক্রীড়াচক্রের সভাপতি শহিদুল সরকার কাজিম। পুকুরের আশপাশের জমির মূল্য এখন গাছপ্রতি কোটি টাকারও বেশি। তাই তিনিও পুকুর এলাকা ছাড়তে চাননি। তিনি পুকুর ভরাট করে সেখানে একটি দোকান ভাড়া নেন।

    এ ব্যাপারে পুকুর মালিক শহিদুল সরকার কাজিমের ছোট ছেলে রাকিবুল হাসান বলেন, “পুকুরের আশেপাশের লোকজন পুকুরে ময়লা-আবর্জনা ফেলে পরিবেশ নষ্ট করেছে। এসব আবর্জনার কারণে দুর্গন্ধ ছিল অসহনীয়। পরে আমরা সেখানে বালু ফেলুন এবং স্থানীয়রা তা ভরাট করে সেখানে একটি দোকান তৈরি করেন।

    পুরান ঢাকার এই এলাকায় আগে ২০ থেকে ২৫টি বড় পুকুর ছিল। এসব পুকুরও বিলীন হয়ে গেছে। এ প্রসঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৫৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাসুদ বলেন, আমার বাড়ি পোস্তগোলা পুকুরের পাশে। শৈশবের স্মৃতির পুকুর ভরাট হয়েছে দশ বছর হয়ে গেল। শুধু তাই নয়, তুলাবাগিচা নামে পুরো এলাকাই ছিল বিশাল পুকুর। হাবিব ম্যাচ ফ্যাক্টরির পেছনে একটি পুকুরও ছিল। কিন্তু এগুলো ছিল ব্যক্তিগত মালিকানাধীন।