পাকিস্তান।রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের বিষাক্ত উত্তরাধিকার
১৯৫১ সালে, ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর পাকিস্তান একটি স্বাধীন দেশ হওয়ার মাত্র চার বছর পর, দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান উত্তরের শহর রাওয়ালপিন্ডিতে একটি জনসভায় গুলিবিদ্ধ হন।
এরপর থেকে নানা সংকটে নিমজ্জিত দেশে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের বিষাক্ত উত্তরাধিকার চলছে। গত বৃহস্পতিবার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান জনসভায় গুলিবিদ্ধ হন। তবে তিনি বেঁচে যান।
প্রায় ১৫ বছর আগে, পাকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ বেনজির ভুট্টোকে রাওয়ালপিন্ডিতে একটি রাজনৈতিক সমাবেশে হত্যা করা হয়েছিল। নির্বাচনের কয়েক সপ্তাহ আগে এ নৃশংস ঘটনা ঘটে। সেই নির্বাচনে তিনি জয়ী হবেন বলে আশা করা হয়েছিল।
ইমরান খান এখন নিঃসন্দেহে পাকিস্তানের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। পায়ে গুলি লাগলেও তিনি অক্ষত। তবে এই ঘটনা পাকিস্তানের রাজনীতিতে যে ক্ষত তৈরি করেছে তা সারতে অনেক সময় লাগতে পারে।
ইমরানের উপর হামলা বছরের পর বছর ধরে দেশের রাজনৈতিক ভারসাম্যকে অস্থিতিশীল করতে পারে। চলতি বছরের শুরুতে তাকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে অপসারণ করা হয়।
তার সমর্থকরা এরই মধ্যে পাকিস্তানের সর্বশক্তিমান প্রতিষ্ঠান সেনাবাহিনীকে দায়ী করে অনেক বিক্ষোভ করেছে। তাদের নেতার উপর আক্রমণ তাদের ক্ষোভকে স্থায়ী করে দিতে পারে।
ইমরানের সমর্থকরাও গুলির ঘটনায় সেনাবাহিনীকে সন্দেহ করে। ইতোমধ্যে তার দলের বিক্ষোভকারীরা সারাদেশে সামরিক স্থাপনা ভাঙচুর করেছে। সেনাবাহিনী ইমরানের ওপর হামলার নিন্দা করলেও পাকিস্তানিরা ভুলে যায়নি যে বেনজির ভুট্টোর হত্যাকারীদের নাম এখনো অজানা। ওই হামলায় এই বাহিনীর জড়িত থাকার বিষয়টি উড়িয়ে দিচ্ছেন না অনেকে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ক্রমাগত বিভিন্ন অভিযোগ তুলেছেন ইমরান। সাম্প্রতিক সময়ে তার জনপ্রিয়তা বেড়ে যাওয়ায় এরই মধ্যে শক্তিশালী সেনাবাহিনী পিছু হটতে শুরু করেছে।
মাত্র এক সপ্তাহ আগে দেশটির প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই প্রধান লেফটেন্যান্ট নাদিম আঞ্জুম এক অভূতপূর্ব সংবাদ সম্মেলনে জোর দিয়েছিলেন যে সামরিক বাহিনী রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ এবং ইমরান একজন প্রতারক। সেনাবাহিনীর ওপর গোপন ও অসাংবিধানিক দাবি তুলেছেন। এর আগে কোনো আইএসআই প্রধান এত নিচে নেমে যাননি।
চলতি মাসের শেষের দিকে অবসরে যাবেন পাকিস্তানের সবচেয়ে ক্ষমতাধর সেনাপ্রধান। কেউ কেউ আশা করে যে এটি সামরিক বাহিনীকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখার পথ সহজ করবে। বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়ার পদত্যাগের পর ইমরান সামরিক বাহিনীর ওপর হামলাও কমাতে পারেন। নতুন সেনাপ্রধান হয়তো বাহিনীর ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ নিতে পারেন। তিনি রাজনীতি থেকে দূরে থাকলে পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে পারে।
তবে পাকিস্তান যে বহুমুখী সংকটে পড়েছে তা থেকে দ্রুত মুক্তির সম্ভাবনা ক্ষীণ। পাকিস্তান অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্বের দ্বারপ্রান্তে। পাকিস্তানের বৈদেশিক ঋণ প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলার। এর প্রায় ৩০ শতাংশ চীন থেকে এসেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল দেশটিকে খেলাপির হাত থেকে বাঁচাতে মাত্র ১.২ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দিতে সম্মত হয়েছে।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এই সংকটে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার পর থেকে দেশটি নৃশংস সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ ও হত্যাকাণ্ডে জর্জরিত। বিশ্লেষকরা বলছেন, পাকিস্তানের রাজনীতি ও সহিংসতা অবিচ্ছেদ্য।
পাকিস্তান বিশেষজ্ঞ বেনেট-জোনস বলেছেন, “পাকিস্তানে, আপনি একটি সংবাদপত্র খুলছেন এবং প্রতিদিন আপনি রাজনৈতিক, আর্থিক, উপজাতীয় বা ধর্মীয় কারণে হত্যার রিপোর্ট দেখতে পাচ্ছেন।
বেনজিরের বাবা জুলফিকার আলী ভুট্টোকে সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত করার দুই বছর পর ১৯৭৯ সালে জেনারেল জিয়াউল হক ফাঁসি দেন। জিয়াও ১৯৮৮ সালে একটি বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান। এটাও রাজনৈতিক শত্রুদের কাজ বলে মনে করা হয়। আবার, বেনজির ভুট্টোর মৃত্যুর সময়, পাকিস্তানি শাসক জেনারেল পারভেজ মোশাররফও বারবার হত্যা প্রচেষ্টার সম্মুখীন হন। মোশাররফ বেঁচে গেলেও ২০০৮ সালে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতেও হত্যাকাণ্ড বন্ধ হয়নি। ২০১১ সালে, সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী শাহবাজ ভাট্টি, একজন খ্রিস্টান, ইসলামাবাদে নিহত হন। কট্টরপন্থী ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলোর একটি জোট দায় স্বীকার করেছে। একই বছর, উদারপন্থী ব্যবসায়ী এবং পাঞ্জাব প্রদেশের গভর্নর সালমান তাসিরকে তার দেহরক্ষীর হাতে গুলি করে হত্যা করা হয়। তাসির এবং ভাট্টি দুজনেই পাকিস্তানের ব্লাসফেমি আইনের সমালোচনা করেছিলেন।
ভুট্টো পরিবারের ওপর একটি বইয়ের লেখক বেনেট-জোনস বলেছেন, ‘রাজনৈতিক সহিংসতার অন্যতম কারণ খুনিদের দায়মুক্তি। খুনিরা জানে, রাজনৈতিক সমর্থন থাকলে তাদের জেলে যেতে হবে না।