পবিত্র হজ।পানিতে ভিজল আরাফাত ময়দান
জাকারিয়া মোহাম্মদ, একজন মিশরীয় নাগরিক, সর্বদা পবিত্র হজ পালনের আশা করেছিলেন। এবার তার ইচ্ছা পূরণ হলো। শুক্রবার আরাফাত স্কয়ারে জড়ো হওয়া হজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে তিনি আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় আমি এখন ঈশ্বরের খুব কাছাকাছি। তিনি আমাকে এই সুযোগ দিয়েছেন। ‘
এদিন জাকারিয়ার মতো আরও লাখো মানুষের কান্নায় সিক্ত হয়েছিল আরাফাত ময়দান। যথাযোগ্য ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে এদিন পবিত্র হজ পালন করা হয়। আত্মশুদ্ধি ও পাপ থেকে মুক্তির আকাঙ্খা নিয়ে হাজিরা আরাফাত চত্বরে দাঁড়িয়েছিলেন। ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়া নি’মাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা শারিকা লাক’ (আমি উপস্থিত, হে আল্লাহ আমি উপস্থিত। তোমার কোন শরীক নেই; সমস্ত প্রশংসা ও নিয়ামত একমাত্র তোমার, সকলের। সাম্রাজ্য তোমার) তারা কান্নায় ভেঙে পড়ে।
আজ সকাল থেকেই সৌদি আরবের আরাফাত স্কয়ারে জড়ো হচ্ছেন দর্শকরা। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সারা বিশ্বের মুসলমানরা সেজেলেস সাদা কাপড়ে সজ্জিত হয়ে এই ঐতিহাসিক ময়দানের তাঁবুতে শিবির করে। সারাদিন কাটিয়ে জোহর ও আসরের নামাজ একসঙ্গে পড়েন। আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় জিকির ও তালবিয়া পাঠে ব্যস্ত ছিলেন। করোনা মহামারির কারণে গত দুই বছর সৌদি আরবের বাইরের কেউ হজে অংশ নিতে পারেন নাই। করোনা পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকায় এবার বড় পরিসরে হজ করার সুযোগ দিল সৌদি সরকার। এ বছর বিভিন্ন দেশের ১০ লাখ মুসলমান হজ করার সুযোগ পেয়েছেন। বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৬০ হাজার মুসল্লি হজে অংশ নেন।
বিদায়ী হজ পালনের জন্য মিনা থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে আরাফাত স্কয়ারে গতকাল সূর্যোদয়ের পর অংশগ্রহণকারীরা জড়ো হন। তিন দিকে পাহাড়ে ঘেরা প্রায় চার বর্গমাইল আয়তনের এই বিশাল সমতল মাঠের এক প্রান্তে রহমতের পাহাড় জাবালে রহমত। ১৪০০ বছরেরও বেশি আগে এখানেই শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.) বিদায় হজের ভাষণ দিয়েছিলেন। কেউ কেউ এই পাহাড়কে প্রার্থনার পাহাড়ও বলে থাকেন। কথিত আছে, হজরত আদম (আ.) ও হজরত হাওয়া (আ.) পৃথিবীতে পুনর্মিলনের পর আরাফাতে আসেন এবং আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
শুক্রবার সূর্যোদয়ের পর হজযাত্রীদের আরাফাত ময়দানের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু বৃহস্পতিবার রাতে মুয়াল্লিম কর্মকর্তারা সেখানে নিয়ে যান। আগে সেখানে পৌঁছে ফজর ও জোহর-আছর আদায় করেন। সেখানে উপস্থিত না থাকলে হজ সম্পন্ন হয় না। তাই যারা হজে এসেছেন এবং হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন তাদেরও অ্যাম্বুলেন্সে করে এখানে আনা হয়। ইসলামী রীতি অনুযায়ী জিলহজ মাসের নবম দিনটি আরাফাতের ময়দানে অতিবাহিত হয়।
এখানকার মসজিদে নামিরা থেকে হজের খুতবা দেন খতিব। এ বছর মাটিতে বসে খুতবা দিয়েছেন শেখ আরাফাত। মুহাম্মদ আব্দুল করিম আল-ঈসা। একই সঙ্গে মসজিদে নামাজও আদায় করেন। এ বছর বাংলাসহ মোট ১৪টি ভাষায় খুতবাটির অনুবাদ শোনা গেছে। দুইজনকে বাংলা অনুবাদক হিসেবে মনোনীত করা হয়েছে। তারা হলেন মোহাম্মদ শোয়েব রশিদ ও তার সহকারী খলিলুর রহমান। মোহাম্মদ শোয়েবের বাড়ি চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলায়। তিনি মক্কার উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয়ে হাদিসে পিএইচডি করছেন। তিনি আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রামের শিক্ষক। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের খতিবও। খলিলুর রহমান মক্কার উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবি ভাষা ও সাহিত্যে পিএইচডি করেছেন।
সারাদিন আরাফাত ময়দানে অবস্থানের পর বিকেলে মুসল্লিরা মিনারের পথে পা রাখেন। তারা প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে মুজদালিফায় মাগরিব ও এশার নামাজ আদায় করেন। সেখানে রাতে খোলা আকাশের নিচে ছিলেন । এটা ওয়াজিব। এই সময়ে তারা প্রয়োজনীয় সংখ্যক পাথর সংগ্রহ করেছিল, যা শনিবার মিনারে নিক্ষেপ করা হবে, প্রতীকী শয়তানকে লক্ষ্য করে। মুজদালিফায় ফজরের নামাজ আদায় করে হাজিরা মিনায় তার তাঁবুতে ফিরে যাবেন। সেখানে বড় শয়তানকে সাতটি পাথর নিক্ষেপের পর পশু কোরবানি দিয়ে মাথার চুল কেটে গোসল করবেন।
এরপর তিনি সাতবার পবিত্র কাবা প্রদক্ষিণ করবেন। এটি হজের আরেকটি ফরজ। কাবার সামনের দুটি পাহাড় হবে সাফা ও মারওয়া সাঈ (সাতবার চলমান)। যতদিন তারা মিনায় থাকবে ততদিন তারা প্রতীকী শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করবে। সবশেষে কাবা শরিফ প্রদক্ষিণ করে বিদায়ী হজের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হবে।
কাবা শরীফে নতুন গিলাফ: পবিত্র কাবা শরীফে শুক্রবার নতুন গিলাফ পরানো হয়েছে। প্রতি বছর (৯ জিলহজ) হজের দিনে হাজীরা সবাই আরাফাত ময়দানে এবং মসজিদে হারামে মুসল্লির সংখ্যা কম থাকে। হাজিরা আরাফাত থেকে ফিরে এসে কাবার উপর নতুন গিলাফ দেখতে পান। পুরানোটি মুছে ফেলা হয় যখন নতুনটি পরা হয়। পুরোনো গিলাফ কেটে মুসলিম দেশগুলোর সরকার প্রধানদের উপহার হিসেবে দেওয়া হয়।