নদী ও সুন্দরবনে রাসায়নিক দূষণ বাড়ছে।আট বছরে ৩৪ টি জাহাজডুবি
গত ৩ মার্চ সুন্দরবনের পশুর নদীর হারবাড়িয়া এলাকায় ৬০০ টন কয়লা নিয়ে ‘এমভি নাওমি’ নামের একটি কার্গো জাহাজ ডুবে যায়। জাহাজের নিচের অংশ ফেটে এ দুর্ঘটনা ঘটে। আট দিনেও জাহাজটি উদ্ধার করা যায়নি। ফলে পানির সংস্পর্শে কয়লার বিভিন্ন রাসায়নিক জোয়ারের সময় নদীর বিভিন্ন এলাকায় ও সুন্দরবনের মাটিতে ছড়িয়ে পড়েছে। এছাড়া ৫ মার্চ যশোরের অভয়নগর উপজেলার ভাটপাড়ায় এমভি সুরাইয়া নামে আরেকটি পণ্যবাহী জাহাজ ডুবে যায়। জাহাজটিতে ১ হাজার ৩৫ টন কয়লা ছিল। একইভাবে কয়লা থেকে বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ নদীগর্ভে এবং আশপাশের পানি ও মাটিতে নির্গত হচ্ছে।
শুধু এই দুটি ঘটনা নয়; আট বছরে সুন্দরবন ও খুলনা-যশোরের বিভিন্ন নদীতে অন্তত ৩৪টি পণ্যবাহী জাহাজ ডুবে গেছে। জাহাজের ফার্নেস অয়েল, কয়লা, সিমেন্ট, ক্লিংকার এবং রাসায়নিক পদার্থ যেমন স্ল্যাগ, পাথর, সার ইত্যাদির কাঁচামাল ডুবে গেছে। বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কিন্তু দুর্ঘটনা ও দূষণ রোধে এবং ডুবন্ত জাহাজ দ্রুত উদ্ধারে সংশ্লিষ্টদের কোনো পদক্ষেপ নেই।
একের পর এক জাহাজ ডুবে যাচ্ছে: মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ, বিআইডব্লিউটিএ ও কার্গো মালিকের মতে, গত ৮ বছরে ডুবে যাওয়া ৩৪টি জাহাজের মধ্যে ২০টি সুন্দরবনের পশুর, শেলা ও মরা ভোলা নদীতে ডুবেছে। এছাড়া খুলনা-যশোরের বিভিন্ন নদীতে ডুবে ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে।
বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী পণ্যবাহী জাহাজ সুন্দরবনের পশুর ও শেলাসহ অন্যান্য নদীতে বারবার তলিয়ে যাচ্ছে। ফলে রাসায়নিক দিয়ে দূষিত হচ্ছে নদীর পানি; ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জলজ জীববৈচিত্র্য। এ ছাড়া সুন্দরবনে ছড়িয়ে পড়ছে পানি দূষণ। পরিবেশ অধিদপ্তর, বন অধিদপ্তর, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় (খুবি) বা অন্য কোনো সংস্থা এসব জাহাজডুবির কারণে ক্ষয়ক্ষতির ধরণ নিয়ে ব্যাপক সমীক্ষা চালায়নি।
তবে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বাস্তুশাস্ত্র বিভাগের প্রধান ড. আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, কয়লায় পারদ, সীসা, ক্যাডমিয়াম, সালফার, ক্রোমিয়াম, নিকেল, অ্যালুমিনিয়ামসহ বিভিন্ন ভারী ধাতু রয়েছে যা পানির সংস্পর্শে আসলেই দ্রবীভূত হয়ে যায়। সারে অ্যামোনিয়াসহ বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ থাকে। ফলে অনেক জায়গায় নদীর পানির দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হচ্ছে। এতে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ও জলজ প্রাণীসহ সমগ্র জলজ জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হচ্ছে। জলজ খাদ্য শৃঙ্খলে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। তিনি বলেন, জোয়ারের সময় নদীর দূষিত পানি বনের মাটিতেও ছড়িয়ে পড়ে। ফলে চারার বৃদ্ধি কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) খুলনা বিভাগীয় সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট মো. বাবুল হাওলাদার বলেন, বেশ কিছুদিন ধরেই সুন্দরবনে জাহাজ ডুবছে। রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হলে কয়লাবাহী জাহাজের আগমন বাড়বে। তাহলে এ ধরনের ঘটনা বাড়তে পারে। তবে ডুবে যাওয়া জাহাজটিকে দ্রুত উদ্ধার করা গেলে পরিবেশের ক্ষতি কম হবে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা) খুলনার সমন্বয়ক মাহফুজুর রহমান মুকুল বলেন, জাহাজডুবির কারণে সুন্দরবনের জন্য হুমকি বাড়ছে। এ ব্যাপারে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবছেন তারা।
একটি বেসরকারি সংস্থা সুন্দরবন একাডেমির নির্বাহী পরিচালক প্রফেসর আনোয়ারুল কাদির সুন্দরবনে বারবার জাহাজডুবির কারণে ক্ষয়ক্ষতির ধরন নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
কর্তৃপক্ষ কী করছে: পরিবেশ অধিদফতরের খুলনা বিভাগের পরিচালক সাইফুর রহমান খান জানান, জাহাজডুবির পর ওই এলাকার পানির নমুনা পরীক্ষা করে প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। পরিবেশ দূষণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে জরিমানাও আদায় করা হয়। এ ছাড়া তারা দ্রুত জাহাজটি তুলে নিতে চিঠি দেয়। তিনি বলেন, জাহাজ ডুবে গেলে পরিবেশ দূষিত হয়- এটা নিশ্চিত।
উদ্ধারকারী জাহাজ নেই : খুলনায় বিআইডব্লিউটিএ বা মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের কোনো উদ্ধারকারী জাহাজ না থাকায় ডুবে যাওয়া জাহাজ ও পণ্যবাহী জাহাজ দ্রুত উদ্ধার করা যাচ্ছে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই স্থানীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে ডুবন্ত জাহাজ উঠানো হয়। আরও প্রয়োজন হলে নারায়ণগঞ্জ বা বরিশাল থেকে বিআইডব্লিউটিএ উদ্ধারকারী জাহাজ আনা হয়। ফলে উদ্ধার কাজে লেগে যায় ২-৩ সপ্তাহ থেকে এক মাস।
বিআইডব্লিউটিএর সমুদ্র সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের যুগ্ম পরিচালক আশরাফ হোসেন বলেন, খুলনা অঞ্চলের জন্য বর্তমানে উদ্ধারকারী জাহাজ কেনার কোনো পরিকল্পনা নেই।
মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ মুসা বলেন, একটি প্রকল্পের আওতায় উদ্ধারকারী জাহাজ কেনার পরিকল্পনা চলছে।