নদীতে নেতাদের পুকুর
চকিরপশার কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার একটি নদী। নুর মোহাম্মদ ষাটের দশকে সবেমাত্র এই নদীতে মাছ ধরা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের আগে পরিবার শুরু করেছিলেন। প্রচুর মাছ ধরা পড়ে জালে। তিনি নিজেও সেই মাছ বাজারে বিক্রি করতেন। বর্ষায় পানি এলে চকিরপাশার ফুলফেঁপে উঠত। এতে নতুন নতুন মাছ ভেসে উঠত। লোকেরা নদীর জলে স্নান করতেন এবং দিনের বেশিরভাগ সময় নদীর তীরে কাটাতেন। মাছের বেপরোয়া ভিড় দেখে হাসতেন নূর মোহাম্মদ। তবে এখন তাকে রিকশা চালিয়ে জীবনযাপন করতে হয়!
স্থানীয়দের মতে, কাজের প্রস্থ কোথাও প্রায় এক কিলোমিটার ছিল। এমনকি ২৫-৩০ বছর আগেও এই নদীর পানি ব্রহ্মপুত্রে প্রবাহিত হত। এখন এই নদীটি উলিপুর উপজেলার থেরেইতে তিস্তা নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। এই নদীটি মূলত বুরিতিস্তা নদীর উজানে। নদীর উত্স কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার সদর ইউনিয়নের ইতাকুরির নিম্ন অঞ্চল (দোলা) থেকে।
রাজারহাটে আবুল কালামের জীবনই ছিল জলাভূমিমুখী। তবে আশির দশকে চকিরপাশা নদীর উপর নিপীড়ন বাড়তে থাকে। নদীর তীরে একটি রাস্তা নির্মাণের ফলে তার প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। তারপরে নদীর উপর বাঁধ দিয়ে পুকুর তৈরির প্রতিযোগিতা চলে। দখলের তালিকায় স্থানীয় নেতা এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। পুকুর নির্মাণের জন্য ধর্মীয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও অভিযোগ রয়েছে। আবুল কালাম শোক প্রকাশ করেছেন যে রাস্তাটি নির্মাণের পরে নদীটি টুকরো টুকরো করে কেটে পুকুরে পরিণত হয়েছে। গভীর নদীর পাড় ধরে এখন দখলের প্রতিযোগিতা রয়েছে। নদীর তীরে মানুষকেও নামতে দেওয়া হচ্ছে না। এই নির্দেশ উপেক্ষা করলেই নেমে আসে অত্যাচার ।
স্থানীয়রা এখনও ভাবতে পারে না যে নদীকে এভাবে টুকরো টুকরো করা যেতে পারে। এদিকে, নীতিনির্ধারকগণ নদীর বা পরবর্তী প্রজন্মের জীবিকা সম্পর্কে চিন্তা করার সময় পান না। এমনকি জেলেরাও তাদের দ্বারা অবহেলিত। বেশিরভাগ চকিরপাশায় এখন ৫০ টিরও বেশি পুকুরের যোগফল। প্রতিটি পুকুরের আকার পাঁচ থেকে ২৫ একর।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নদীর তীরের এক বাসিন্দা বলেন, ‘প্রশাসনের লোকেরা নদী দখলকারীদের নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। সরকারী অর্থ দিয়ে কেনা ফিশ ফ্রাই নদীতে ছেড়ে দেওয়া হয়।
এদিকে, প্রশাসন নদীর তীরে জলাশয়ে মাছ চাষে মানুষকে উত্সাহিত করছে। তবে মাছ চাষ সমবায়ীরাও দলীয় রাজনীতির আখড়া হিসাবে যাত্রা শুরু করেছেন। প্রজন্ম ধরে যাঁরা মাছ ধরেন তাদের জেলেদের পরিচয়পত্র থাকলেও তাদের মাছ ধরার কোনও অধিকার নেই। আবুল কালামের আইডি কার্ডটি একজন জেলেদের হলেও, নদীতে মাছ ধরার তার কোনও অধিকার নেই।চকিরপাশার নদী রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক খন্দকার আরিফ জানান, উজানের বিভিন্ন বাধার মধ্য দিয়ে পানির প্রবাহ বাধার কারণে দুটি ফসলি জমি অনুর্বর হয়ে পড়েছে। গজেন্দ্রনাথ রায় নামে এক কৃষক জানান, এ বছর তার পাঁচ একর জমিতে তিনি কিছু চাষ করতে পারেন নাই। এখানকার পরিস্থিতি খুবই শোচনীয়।