ধানে ধনী হওয়া ‘চাল’
হাজী আব্দুল কুদ্দুস কুদু। বগুড়ার শেরপুরের চালকল মালিক সমিতির সভাপতি তার একাই ১০টি গুদাম রয়েছে, সবগুলোই চালের বস্তায় ভর্তি। কি বস্তা! আবদুল কুদ্দুস হয়তো সে হিসাব জানেন না। কিন্তু কৌশলগুলো সবারই জানা। এই দুঃসময়ে তিনি ধান বিক্রি করে ধনী হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, গুদামে ধান সর্বোচ্চ ৩০ দিন এবং চাল ১৫ দিন সংরক্ষণ করা যায়। নিয়ম মেনে চলুন! শ্রমিকরা নিজেরাই জানান, তাদের গুদামে গত বছরের ধান রয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় চালের দাম ফের বাড়লে আবদুল কুদ্দুসের গুদামে তালা দেওয়া হয়। শুধু কুদ্দুস নয়; শেরপুরের সিরাজুল ইসলাম, হিটলার হোসেন, হাসেম আলী, আমিনুল ইসলাম মিন্টু, আলামিন হোসেন, গোলাম রব্বানীসহ একাধিক প্রভাবশালী ধান-চাল ব্যবসায়ীর গুদামে মজুদ রয়েছে হাজার হাজার বস্তা ধান-চাল।
উত্তরাঞ্চলে ধান ও চালের অবৈধ মজুদকারীদের কারণে চালের বাজারদর নিয়ন্ত্রণে আসছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। মজুদদারির কারণে উত্তরাঞ্চলের বাজারে ধানের সরবরাহ কমে গেছে। ফলে চালের দাম বাড়ছে। স্বাভাবিক সরবরাহ না থাকায় বেশি দামে ধান কেনার কারণে বাড়ছে চালের দাম। মজুদদারদের গুদামে আটকে থাকা কয়েক হাজার মণ চাল বাজারে ছাড়া হলে চালের দাম কমে যেত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ধান মজুতকারীদের পাশাপাশি বাজার নিয়ন্ত্রণকারী কয়েকজন ধান মালিকও অতিরিক্ত চাল মজুদ করে রেখেছেন। দাম বাড়ার কারণে এ চাল বাজারে ছাড়া হচ্ছে না। সব মিলিয়ে বাজারে চালের ঘাটতি রয়েছে। দেশের প্রধান চাল ও ধানের বাজার দিনাজপুর, নওগাঁ, জয়পুরহাট ও বগুড়ার বাজারে অনুসন্ধান করে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
সংশ্লিষ্ট জেলার খাদ্য কর্মকর্তারা জানান, মজুদ রোধে তারা অটো মিলের গুদাম পরিদর্শনসহ নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছেন। কিন্তু বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত। উত্তরাঞ্চলের অর্ধশতাধিক অটো রাইস মিলের গুদামে এখনও হাজার হাজার মণ ধান মজুত রয়েছে বলে গোপন সূত্রে জানা গেছে। বাংলাদেশ অটো রাইস মিল মালিক সমিতির সভাপতি একেএম খোরশেদ আলম খান বলেন, বেসরকারিভাবে কত ধান মজুত আছে তার তথ্য বের করতে হবে। ধান কোথায় মজুদ করা হয়েছে, কেন আছে- সেটা সরকারের সংশ্লিষ্টদের দেখতে হবে। তাহলেই চালের দাম বাড়ার কারণ জানা যাবে।
যাদের মজুদ রয়েছে: বগুড়ার শেরপুর শহর থেকে আড়াই কিলোমিটার দক্ষিণে শেরুয়া বটতলা বাজার। ঢাকা-বগুড়া মহাসড়কের পাশের এ বাজারের আশপাশে শতাধিক ছোট-বড় চাতাল দেখা যায়। অটোমেটিক রাইস মিলসহ বেশ কয়েকটি সেমি-অটো রাইস মিল রয়েছে। ওই বাজার থেকে মাত্র দুইশ গজ দক্ষিণে চারটি বড় চাতাল দেখা যায়। চাতালের পাশেই গুদাম। অপর পাশে দুটি সেমি-অটো রাইস মিল। চাতালে প্রায় দুই শতাধিক নারী-পুরুষ ধান শুকাতে ব্যস্ত। মিল-চট্টল সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা জানান, এগুলোর মালিক হাজী আব্দুল কুদ্দুস কুদু। তিনি চারটি গুদামের মালিক এবং ছয়টি ভাড়া দেন।
শেরুয়ার বটতলার আব্দুল কুদ্দুসের মতো আরও ব্যবসায়ী আছেন, তাদের কল-চাতালায়ও একই চিত্র দেখা গেছে। অনেকে সরকারি নিয়ম না মেনে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে গুদামে ধান-চাল মজুদ করে রেখেছেন। শেরপুরের আলাল অটোমেটিক রাইস মিল, নর্থ বেঙ্গল অটোমেটিক রাইস মিল, শিনু অটোমেটিক রাইস মিল ও মজুমদার অটোমেটিক রাইস মিলের হাজার হাজার বস্তা ধান ও চাল মজুদ রয়েছে।
এ ব্যাপারে শেরপুর চাকল মালিক সমিতির সভাপতি আব্দুল কুদ্দুস কুদু বলেন, আমি দীর্ঘদিন ধরে এ ব্যবসা করে আসছি। মজুদ নিয়ে আমার কখনো সমস্যা হয়নি। এখন বাজার খারাপ, তাই নানা নিয়ম মানা হচ্ছে।’ এ উপজেলার অনেক ব্যবসায়ীর ধান-চাল রয়েছে বলে তিনি দাবি করেন। তারা বিক্রিও করছে। তাদের কোন খারাপ উদ্দেশ্য নেই।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নওগাঁ ন্যাশনাল অটো রাইস মিল, বেলকন কোম্পানি, সরস্বতীপুর এসিআই কোম্পানি, মহাদেবপুর বিসমিল্লাহ অটো রাইস মিল, লস্করপুর ঘোষ অটো রাইস মিল, কালিতলা সুলতানপুর সুফিয়া অটো রাইস মিল, এমকে অটো রাইস মিল, বাইপাস মোড় তসিরুন অটো রাইস মিল, সরদারপুর অটো রাইস মিল। অটো রাইস মিল, আনন্দনগরের আরএম রাইস মিল, লস্করপুরের খগেন রাইস মিলে হাজার হাজার মণ ধান ও চাল রয়েছে।
জয়পুরহাট সদরের সাদিয়া রাইস মিল, পাঁচবিবি উপজেলা সদরের মাল রাইস মিল, আক্কেলপুর উপজেলা সদরের মাহীন রাইস মিল, কালাই পাঁচশিরা বাজারের থ্রি ফুডস প্রসেসিং মিলের গুদামে হাজার হাজার মণ ধান ও চাল রয়েছে। দিনাজপুরের ১৩টি উপজেলায় প্রায় ২০০০টি রাইস মিল রয়েছে। এর মধ্যে অটো রাইস মিল ও হট ফ্লু মিল প্রায় দুই শতাধিক। এ ছাড়া বাকিগুলো বড় মিল ও হাসকিং মিল। দিনাজপুর সদর, বীরগঞ্জ ও বোচাগঞ্জে সবচেয়ে বেশি ধান চাষ হয়। এখানকার প্রায় প্রতিটি বড় মিলের হাজার হাজার মণ ধান ও চাল মজুদ রয়েছে।
মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ)
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন বাজার মনিটরিং সংস্থা জানিয়েছে, কয়েক বছরের তুলনায় বাজারে চালের দাম অনেক বেশি। ধান মজুদের কারণে দাম বাড়লে তা ঠেকাতে অধিদফতরের একাধিক টিম কাজ করছে। কোনো অসঙ্গতি থাকলে অসাধুদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনা হবে।
পরিবহন খরচ কেমন: হঠাৎ করে চালের দাম বেড়ে যাওয়ার পেছনে পরিবহন খরচ বেশির ভাগই দায়ী। কিন্তু বিভিন্ন জায়গায় দূরত্ব অনুযায়ী পরিবহন খরচের হিসেব নেই। তেলের দাম বৃদ্ধির পর দিনাজপুর থেকে আড়াইশ বস্তা (১৭,৫০০ কেজি) চাল বহনকারী একটি ট্রাককে দিতে হচ্ছে ১৮ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা। এর পাশাপাশি ব্যাগ প্রতি শ্রম খরচ (৭০ কেজি) এবং শুল্ক যোগ করে আরও ১৪ টাকা। অন্য কথায়, খরচ যোগ করার পর প্রতি কেজি দাম ১.২২ টাকা থেকে ১.৩৪ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়।
একই চিত্র নওগাঁয়। সেখান থেকে আড়াইশ বস্তা চাল রাজধানীতে আনতে ট্রাক ভাড়া লাগে ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকা। শ্রম খরচ এবং প্রতি ব্যাগ হ্যান্ডলিং বাবদ আরও ১৪ টাকা চার্জ করতে হবে। হিসাব করলে দেখা যায়, নওগাঁ থেকে ঢাকায় চাল আনতে সর্বোচ্চ খরচ হয় প্রতি কেজি ১ টাকা থেকে ১ টাকা ১০ পয়সা। কিন্তু চালের দাম বলছে ভিন্ন কথা। অসাধু সিন্ডিকেটের কারণে চালের দাম কেজিতে ৫ টাকা থেকে ১০ টাকা বেড়েছে।