তেল-চিনি নাই হয়ে যায় কেন?
এক বছর হতে চলল বাজারে অন্যান্য নিত্যপণ্যের পাশাপাশি বাড়ছে ভোজ্যতেলের দাম। অত্যাবশ্যকীয় এই রান্নার উপকরণের দাম ইতিমধ্যে দ্বিগুণ হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও অভ্যন্তরীণ বাজারে তা সমন্বয় করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। মাঝে মাঝে সমন্বয়ের নামে তা কিছুটা কমানো হলেও এক মাসের মধ্যে আবার বাড়ানোর প্রস্তাব নিয়ে আসে মালিকপক্ষ। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও সেই প্রস্তাবের প্রতি ‘শ্রদ্ধেয়’ এবং পর্যায়ক্রমে দাম বাড়াচ্ছে।
তবে বৃদ্ধির বোঝা ভোক্তাদের কাঁধে চাপলেও কমানোর সুফল তারা পাচ্ছে না। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিলেই আগের দামে কেনা তেল বেশি দামে বিক্রি শুরু হয়। এমনকি বোতলজাত তেলের গায়ে দাম লেখা থাকা সত্ত্বেও বিক্রি করা হয় স্ফীত দামে। তবে দাম কমানোর ঘোষণা দিলেও বাজারে পৌঁছাতে দুই সপ্তাহ সময় লাগবে এই অজুহাতে আগের বর্ধিত দামেই বিক্রি করা হবে নতুন তেল। দুই সপ্তাহ পর নতুন তেল বাজারে এলে প্রায় এক সপ্তাহ বাজার স্বাভাবিক থাকে। এরপর আমাদের ব্যবসায়িক সিন্ডিকেট আবার দাম বাড়ানো শুরু করে। তারা ভোজ্যতেলের বাজারে একচেটিয়া ৫-৬টি কোম্পানির হাতে ব্যবসায়িক মুনাফা করছে।
সিন্ডিকেটের দাম বাড়ানোর কৌশল হিসেবে সামনে রাখা হয়েছে নানা কারণ। ভোজ্য তেলের কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। তাই প্রথমে তারা বলতে শুরু করে কাঁচামালের দাম বেড়েছে, তেলের দাম না বাড়লে লোকসান গুনতে হবে। দাম বাড়ানোর প্রস্তাব পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে অর্থের ওপর ‘আমরা করব’ লেখার বিষয়টি বিবেচনায় না নিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয়ের পাশাপাশি বাস্তবতা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। ইচ্ছা করলে এর বাহককে তা পরিশোধ করতে বাধ্য’। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ঘোষণা দিতে মন্ত্রণালয় যত বেশি দেরি করে, সিন্ডিকেট ততোই কৌশল খোঁজে। এই কৌশলের অংশ হিসাবে, ভোজ্যতেল এবং চিনি কখনও কখনও বাজার থেকে বাদ দেওয়া হয়।
‘হঠাৎ করে বাজারে সয়াবিন তেল পাওয়া যাচ্ছে না। বিশেষ করে দোকানে টাকা দিয়েও বোতলজাত সয়াবিন তেল কিনতে না পারার অভিযোগ ছিল লোকজনের। গত বৃহস্পতিবার বোতলজাত সয়াবিনের দাম লিটারে ১২ টাকা বেড়েছে। এ ঘোষণার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বাজারে নতুন দামে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সরবরাহ বেড়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে হাতিরপুল কাঁচাবাজার, কারওয়ান মার্কেট, মহাখালী কাঁচাবাজার, মালিবাগসহ কয়েকটি এলাকায় খোঁজ নিয়ে এ চিত্র দেখা যায়। সিন্ডিকেট ভোক্তাদের জিম্মি করার জন্য কৃত্রিম সরবরাহের ঘাটতি তৈরি করেছে – এটি বের করার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই।
আরও দেখা যায়, ‘তেল মিললেও চিনির ক্ষেত্রে কোনো স্বস্তি মেলেনি’। দাম বাড়ার পরও বাড়েনি চিনির সরবরাহ। চিনির বাজারে সরবরাহ কম রেখে দাম বৃদ্ধির আরেক দফা টানা হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখা দরকার। দেশের উত্তরাঞ্চলে পর্যাপ্ত পরিমাণ আখ চাষ হচ্ছে। চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, চাঁদপুর ছাড়াও সারাদেশেই কমবেশি আখ চাষ হচ্ছে। কৃষি বিভাগ সক্রিয় থাকলে এ দেশের উর্বর মাটিতে ফলন বাড়ানো সম্ভব। এটি করা হলে বিদেশ থেকে চিনি আমদানির প্রয়োজন হবে না। আমাদের রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলোকে আধুনিকায়ন করলেই এই সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে কোনো সরকারই সে পথে হাঁটছে না। মনে হচ্ছে, সরকারের উদ্দেশ্য রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলোকে লোকসানে রেখে চিনি সিন্ডিকেটকে সুফল পেতে দেওয়া। অর্থাৎ ৫-৬টি কর্পোরেট কোম্পানির কাছে ভোক্তারা জিম্মি। তাদের আমদানি করা চিনি রাসায়নিক দিয়ে ব্লিচ করা হচ্ছে, যা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু দেশীয় লাল চিনি তুলনামূলকভাবে বেশি পুষ্টিকর।
ভোজ্যতেলের আমদানি নির্ভরতা কমাতে চিনির পাশাপাশি এ দেশে সয়াবিন চাষ করা যেতে পারে। বাংলাদেশের তৃণভূমির মাটি সয়াবিন ও সূর্যমুখী চাষের জন্য খুবই উপযোগী। এটি করার কোন প্রবণতা লক্ষণীয় নয়। প্রণোদনা ঘোষণা করে বসে থাকলে কৃষকরা উদ্বুদ্ধ হবে না। তা বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নিতে হবে। এছাড়াও সিন্ডিকেটের জাল থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বাজারের নিয়ন্ত্রণ সরকারের হাতে আনতে হবে। সিন্ডিকেট শুধু ভোক্তাকেই জিম্মি করে না, সরকারকেও। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব দূর করতে হবে। সম্প্রতি ডিমের দাম বাড়ার পর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আমদানির বিরোধিতা করে কৃষি মন্ত্রণালয়। দেশীয় শিল্পকে বাঁচাতে হবে।