জাতীয়

তিন জালের ফাঁদে পড়ে মা মাছের সর্বনাশ।হালদা নদী

চট্টগ্রামের হালদা নদীই দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননক্ষেত্র। কার্প প্রজাতি- রুই, কাতলা ও কালবাউশ বছরের এপ্রিল থেকে মে মাসের মধ্যে হালদায় ডিম পাড়ে। বিশেষ করে অমাবস্যা বা পূর্ণিমায় প্রবল বজ্রপাত হলে মা মাছ ডিম পাড়ে। তবে তার আগে এসব মাছ ডিম পাড়ার জন্য হালদায় আসত। হালদায় সারা বছরই মাছ ধরা বেআইনি থাকলেও বছরের এই সময়েই মরিয়া হয়ে ওঠে শিকারীরা। কারণ, এ সময় বড় সাইজের মা মাছ পাওয়া যায়। এসব মাছ আবার বেশ সুস্বাদু। ফলে চাহিদা বেশি। তাই হালদায় মা মাছের প্রবেশের পর থেকে মাছ শিকারির সংখ্যা বেড়েছে। একের পর এক অপারেশন করেও ফাঁদ বন্ধ হচ্ছে না; মা মাছ নিধন বন্ধ হচ্ছে না।

হালদায় তিন ধরনের জাল দিয়ে মাছ শিকার করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। একটি ‘ভাসমান জাল’, একটি ‘ঘেরা জাল’, অন্যটি ‘বেহুন্দি জাল’। এই তিন ধরনের জালকে মা মাছের ‘যাম’ বলা হয়। এর মধ্যে কোনো মাছ ধরা পড়লে সেই মাছের নিস্তার নেই। নদীর এক পাড়ে চারঘেরা জাল বসানো হয়েছে। নদীর ধারে সুবিধাজনক স্থানে ভাসমান জালের ফাঁদ দেওয়া হয়। এই জাল ভাসিয়ে রাখতে শোলা ব্যবহার করা হয়। আর বেহুন্দি জালের পাতা দিয়ে তৈরি করা হয় ‘ফিক্সড ইঞ্জিন’। তিনটি জালই প্রায় সমান ক্ষতিকর। তবে অকেজো জাল ব্যবহার করে দ্রুত মাছ ধরে পালানো সম্ভব। তাই অভিযানে বিভিন্ন সময়ে ভাসমান জাল ও চারঘেরা জাল জব্দ করা গেলেও বেহুন্দি জাল খুব একটা ধরা পড়েনি।

হালদায় ভাসমান তিন ধরনের জালের দাম বেশ চড়া। একটি বৃত্তাকার জালের (৩০-৪০ মিটার) দাম প্রায় এক হাজার টাকা। একটি বেহুন্দি জালের (৫০-৬০ মিটার) দামও এক হাজার টাকা।

ভাসমান জালের দামও কাছাকাছি। ফলে সাধারণ জেলেদের পক্ষে এই জাল কিনে হালদায় ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন হালদা গবেষকরা। তাদের ধারণা, কিছু অসাধু ধনী জেলে ও অন্য পেশার বিত্তবানরা সুযোগ কাজে লাগিয়ে হালদায় মাছ ধরছে। অনেকে অবশ্য টাকার জন্য মাছ ধরার জন্য সাধারণ জেলেদের ব্যবহার করেন।

দীর্ঘদিন ধরে হালদা নিয়ে কাজ করছেন হালদা নদী গবেষণা ল্যাবরেটরির সমন্বয়ক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মঞ্জুরুল কিবরিয়া। তিনি বলেন, হালদায় তিন ধরনের জাল দিয়ে নির্বিচারে মাছ ধরা চলছে। তিনটি জালই মাছ ধরার ক্ষেত্রে খুবই কার্যকর। হালদা নদীর মাছ যেমন সুস্বাদু তেমনি দামেও চাহিদা বেশি। এ কারণে এক শ্রেণির মানুষ হালদার মাছ শিকারে ব্যাপক বিনিয়োগ করতে দ্বিধা করেন না। তবে একটি মা মাছ শিকারে মৎস্য সম্পদের কত ক্ষতি হয় তা লোভী শিকারীরা বুঝতে চায় না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মা মাছ শিকার মানেই শুধু মাছ শিকার নয়। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, প্রজনন ঋতুতে মাছের বয়স, ওজন ও আকৃতি ভেদে একটি মা মাছের পেটে সাধারণত তিন লাখ থেকে ৩৫ লাখ ডিম থাকে। সেই নিষিক্ত ডিম থেকে পরাগ আসে। পরাগ থেকে ধান আসে, ধান থেকে আঙ্গুল আসে এবং আঙুল থেকে মাছ আসে। হিসাব করে দেখা গেছে একটি মাছ থেকে প্রাপ্ত ডিমের সংখ্যা এবং সেই ডিম থেকে উৎপাদিত মাছের সংখ্যা চার কোটির কম। বলা যায়, একটি নিখুঁত মা মাছের ক্ষতি চার কোটি টাকা।

জানা গেছে, হালদারের মা এর আগে মাছ রক্ষায় কোনো উদ্যোগ নেননি। সাধারণ জেলেদের পাশাপাশি অপেশাদাররাও নির্বিচারে মাছ ধরছিল। রুই, কাতলা, কালবাউশ ছাড়াও চিংড়ি, আইড়, বোয়ালসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ জালে ধরা পড়ে। তবে চট্টগ্রামবাসীর দীর্ঘদিনের আন্দোলনের মুখে সরকার হালদাকে ‘বঙ্গবন্ধু মৎস্য ঐতিহ্য’ ঘোষণার পর থেকে অবৈধ মাছ ধরা বন্ধে অভিযান চালাচ্ছে চট্টগ্রাম নৌ পুলিশ।

নৌ পুলিশের ওসি এবিএম মিজানুর রহমান শিকারিদের জাল ফেলার কৌশল তুলে ধরে বলেন, পূর্ণিমা ও অমাবস্যার সময় পানি পরিষ্কার হলে নদীতে মাছ ভেসে উঠতে শুরু করে। স্বচ্ছ পানিতে এসব মাছকে বিচরণ করতে দেখা যায়। ফলে অনেকেই লোভ সামলাতে পারে না। কোরাল, ঈল ও চিংড়ি ছাড়াও মা মাছ রয়েছে।

মন্তব্য করুন