• বাংলা
  • English
  • জাতীয়

    ডেক ক্যাডেট রাশেদের মৃত্যু কি পরিকল্পিত হত্যা?

    ভারতের মুম্বাইয়ে বাংলাদেশি জাহাজ এমভি জাহান মণিতে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অব্যাহত মানসিক নির্যাতন ও চিকিৎসায় গাফিলতির কারণে আবু রাশেদ (২২) নামে এক ডেক ক্যাডেটের মৃত্যুর অভিযোগ ওঠেছে।

    নিহত আবু রাশেদ এসআর শিপিং কোম্পানির এমভি জাহান মণি জাহাজে ডেক ক্যাডেট হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি যশোর জেলার মনিরামপুর এলাকার মনোহরপুর গ্রামের মো. আবু সবুর ও পারুল বেগমের ছেলে।

    মেরিন ফিশারিজ একাডেমির ৪০ তম ব্যাচের নটিক্যাল বিভাগের ক্যাডেট রাশেদ ২০২০ সালে তার কোর্স পাশ করে জাহাজে যোগদান করেন। সফলভাবে একটি ট্রিপ শেষ করে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ডেক ক্যাডেট হিসেবে এসআর শিপিংয়ের এমভি জাহান মণি জাহাজে ওঠেন তিনি।

    আবু রাশেদের পরিবার ও সহকর্মীদের অভিযোগ, জাহাজের চীফ অফিসার বিপ্লব চন্দ্র শীল ও ক্যাপ্টেন আহছানুল হকের অব্যাহত মানসিক নির্যাতন, চিকিৎসায় গাফিলতি ও অসুস্থ অবস্থায় একটানা ১৬ থেকে ১৮ ঘন্টা দায়িত্ব পালনে বাধ্য করায় শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে আবু রাশেদের মৃত্যু হয়েছে।

    অভিযোগ উঠেছে, জাহাজের চীফ অফিসার বিপ্লব চন্দ্র শীল জাহাজে ‘অনবোর্ড’ হওয়ার পর থেকেই আবু রাশেদের উপর নানাভাবে শারীরিক-মানসিক নির্যাতন চালিয়ে আসছিলেন। চীন, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনে আবু রাশেদ চরম অসুস্থ হয়ে পড়লেও তাকে পর্যাপ্ত চিকিৎসা দেয়া হয়নি। উল্টো গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় আবু রাশেদকে দৈনিক ১৬ থেকে ১৮ ঘন্টা দায়িত্ব পালনে বাধ্য করা হয়েছে।

    রাশেদের সহকর্মীদের অভিযোগ, এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে রাশেদ প্রচণ্ড জ্বরে আক্রান্ত হলে তাকে ৩ দিন জাহাজে আইসোলেটেড করে রাখা হয়। পরবর্তীতে কিছুটা সুস্থ হয়ে ওঠলে পর্যাপ্ত বিশ্রামের সুযোগ না দিয়ে পুনরায় তাকে দৈনিক ১৬ থেকে ১৮ ঘন্টা দায়িত্ব পালনে বাধ্য করতেন চীফ অফিসার বিপ্লব চন্দ্র শীল। শুধু তাই নয়, একাধিকবার রাশেদ জাহাজে অসুস্থ অনুভব করলে এন্টিবায়োটিক খাইয়ে সাথে সাথে দায়িত্ব পালনে বাধ্য করা হয়। এভাবে দিন দিন তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে।

    সপ্তাহখানেক ধরে বমি হতে থাকলেও তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়নি। সর্বশেষ অসুস্থ শরীরে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে গত ৩১ মে রাতে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন আবু রাশেদ। এসময় তার প্রচণ্ড রক্তবমি হয়। পরে ফ্রেশ ওয়াটারের বোটে করে তাকে মুম্বাইয়ের শোরে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ওই সময় কানের সমস্যায় আক্রান্ত আরেকজন ওয়েলারকেও আবু রাশেদের সঙ্গে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে ওইদিন রাতেই ভারতের মুম্বাইয়ের একটি হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়।

    নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাশেদের একজন সহকর্মী বলেন, ‘জাহাজের চীফ অফিসার বিপ্লব চন্দ্র শীল অত্যন্ত বাজে প্রকৃতির লোক। তিনি সবসময় আবু রাশেদের উপর নানাভাবে মানসিক নির্যাতন চালাতেন। রাত ৩ টা থেকে ১১ টা পর্যন্ত একটানা দায়িত্ব পালনে বাধ্য করতেন। দায়িত্ব পালনে কোন ভুল হলে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করতেন, তাকে মারার হুমকি দিতেন। অসম্মানজনক কথা বলে রাশেদকে মানসিক টর্চার করতেন।’

     

    তিনি আরও বলেন, ‘রাশেদের শারীরিক অবস্থার চরম অবনতি হলেও তাকে আইসিইউতে নেয়া হয়নি। চিকিৎসা অবহেলায় ধুকে ধুকে মরতে হয় রাশেদকে। এর আগে চীন, ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়াতেও তার শারীরিক অবনতি হলে তাকে চিকিৎসা দেয়া হয়নি। মূলত মেরিন ফিশারিজ একাডেমি থেকে বাণিজ্যিক জাহাজে আসায় শুরু থেকেই জাহাজের চীপ অফিসার বিপ্লব চন্দ্র শীল ও ক্যাপ্টেন আহছানুল হক আবু রাশেদের উপর হিংসাত্মক মনোভাব পোষণ করে আসছিলেন।’

    রাশেদের একাধিক সহপাঠী জানান, ভারতে থাকা অবস্থায় আবু রাশেদ তার ওপর চীফ অফিসার বিপ্লব চন্দ্র শীলের নির্যাতনের খবর বাইরে অন্য সহকর্মী ও কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে জানান। ফলে ওই জাহাজে কর্মরত আবু রাশেদের সহকর্মীদের মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়।

    এদিকে আবু রাশেদের মৃত্যুর কারণ নিয়ে ওঠেছে নানা প্রশ্ন। তার মৃত্যুকে অসুস্থতা বলে চালিয়ে দিচ্ছে জাহাজ কর্তৃপক্ষ এমন অভিযোগ রাশেদের সহকর্মীদের। রাশেদের সহকর্মী, বন্ধুরা৷ বলছেন, আবু রাশেদের মৃত্যুর পর থেকে তাকে এ্যাজমা রোগী বলা হচ্ছে। অথচ তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ, সপ্রতিভ ও ২২ বছরের টগবগে যুবক ছিলেন। তাছাড়া জাহাজে ওঠার আগে সিভিল সার্জনের মেডিকেল সনদসহ যেকোন ক্যাডেটকে যাবতীয় ডাক্তারি সনদ নিয়েই যেতে হয়। অসুস্থ বা কোন রোগের রোগী হলে তার জাহাজে চাকরি হওয়ার সুযোগ নেই। আবু রাশেদ যদি অসুস্থই হতেন তাহলে তিনি একাডেমিতে পড়াশোনা করা অবস্থয় কীভাবে প্রতিদিন পিটি, প্যারেড ও গেমসে অংশগ্রহণ করতেন। কীভাবে তিনি ১৬’শ মিটার দৌড় প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পান? কীভাবে তিনি বিউগল বাজাতেন? একজন অসুস্থ রোগীর পক্ষে এসব কর্মকাণ্ড কখনোই সম্ভব নয়।

    অন্যদিকে পরিবারেরও একই দাবি। তারা বলছেন, আবু রাশেদ সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় জাহাজে ওঠেছেন। তিনি আগে কখনোই কোন রোগে ভুগেননি। এ বিষয়ে নিহত আবু রাশেদের ভাই মো. রাসেল বলেন, ‘আমার ভাই কখনো কোন রোগে ভুগেনি। বলা হচ্ছে তার এ্যাজমা রয়েছে। এ ধরণের কোন রোগ তার ছিলো না। সে সবসময় সুস্থ ছিল। সে এর আগে একটি ট্রিপে জাহাজ থেকে নেমে সুস্থভাবেই দ্বিতীয়বার এ জাহাজে ওঠেছিল। এ জাহাজে ওঠার পর থেকেই বিভিন্ন অসুবিধার কথা আমাদের জানাতো। অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনের কথা বলে মন খারাপ করতো। আজকে আমার ভাইকেও হারিয়ে ফেললাম। আমরা তার প্রতি অবিচারকারীদের শাস্তি চাই।’

    জানতে চাইলে মেরিন ফিশারিজ একাডেমি এক্স-ক্যাডেট এসোসিয়েশনের সভাপতি কমডোর (অব.) সৈয়দ আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘জাহাজে ওঠার আগে একজন ক্যাডেটের সব ধরণের শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন করেই তাকে জাহাজে তোলা হয়। তবে ঠিক কী কারণে তার মৃত্যু হয়েছে তা আমরা বলতে পারছি না। আমরা চাই কেউ যদি দোষী হয়ে থাকে বা তার প্রতি অন্যায় হয়ে থাকে তাহলে তার বিচার হোক এবং নিহত ক্যাডেটের পরিবারকে ন্যায্য ক্ষতিপূরণ বুঝিয়ে দেয়া হোক।’

     

    এ বিষয়ে অভিযুক্ত এমভি জাহান মণি জাহাজের চীফ অফিসার বিপ্লব চন্দ্র শীল ও ক্যাপ্টেন আহছানুল হকের বক্তব্য জানার চেষ্টা করি দেশের বাইরে থাকায় হোয়াটসঅ্যাপে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও সাড়া মিলেনি।

    মন্তব্য করুন