জাতিসংঘে উঠেছে একাত্তরের গণহত্যার স্বীকৃতির দাবি
বাঙালি হত্যা ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনী বাংলাদেশে যে পরিকল্পিত ও ব্যাপক গণহত্যা চালিয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আর কোথাও ঘটেনি। তবে ৫১ বছরেও বাংলাদেশিদের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংস গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মেলেনি। স্বীকৃতির অভাবে পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের এখনো আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের মুখোমুখি করা হয়নি।
সরকার বিভিন্ন সময়ে গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার চেষ্টার কথা বললেও তা থেমে গেছে। তবে এবার বেসরকারি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য সমন্বিত কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনে তিন পৃষ্ঠার একটি প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে। রেজোলিউশনে পাকিস্তানের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, গণহত্যায় জড়িত পাকিস্তানি বাহিনীর বিচার এবং ১৯৪৮ সালের জাতিসংঘ কনভেনশন অনুযায়ী গণহত্যা ও যুদ্ধের শিকারদের জন্য ক্ষতিপূরণের আহ্বান জানানো হয়েছে। ৩ অক্টোবর সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের ৫১তম অধিবেশনে এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে।
জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিল বাংলাদেশে একাত্তরের ভয়াবহ, বীভৎস, বর্বরোচিত গণহত্যা ও গণহত্যা নিয়ে আলোচনা করবে। একই দিনে গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবিতে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আলোচনা সভা, মশাল প্রজ্জ্বলন ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়। . এ ছাড়া ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত দেশে ও বিদেশে ‘গণহত্যা স্বীকৃতি সপ্তাহ’ পালনের কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে।
জেনেভা, সুইজারল্যান্ড এবং নিউইয়র্ক, যুক্তরাজ্যে জাতিসংঘ ভবন ছাড়াও লন্ডন, কানাডা, টরন্টো এবং মন্ট্রিল, যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা এবং অস্ট্রেলিয়ার সিডনিসহ বিভিন্ন শহরে সংহতি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। জাতিসংঘের দশটি সদস্য রাষ্ট্রকে স্মারকলিপি দেওয়া হবে।
কর্মসূচি অনুযায়ী আগামী ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় প্রেসক্লাবের সামনে সমাবেশ ও মানববন্ধন, ২ অক্টোবর বিকেল ৪টায় নিউইয়র্ক জাতিসংঘ ভবন, লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশন, সিডনি, টরন্টো। , মন্ট্রিল র্যালি ও মানববন্ধন এবং ৩ অক্টোবর বিকাল ৩টায় জেনেভায় জাতিসংঘ ভবনের XXV রুমে। দেশের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এ কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হবে।
এ প্রসঙ্গে আমারা ১১-এর প্রধান সমন্বয়ক হিলাল ফয়েজী বলেন, ‘আমরা তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির উদ্যোগ জোরদার করছি। এটা আমাদের জন্য মুক্তিযুদ্ধের নতুন পর্ব। এই সংগ্রামে দেশ-বিদেশের সকল বাংলাদেশিকে নতুন উদ্যমে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।’
বিষয়টি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের নজরে আনা হলে তিনি বলেন, ‘সরকার গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা করছে। তবে অনেক কূটনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক সমস্যা রয়েছে। প্রয়োজনে সরকার এ ব্যাপারে ইতিবাচক ভূমিকা নেবে। তবে বেসরকারি পর্যায়ে গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য যারা কাজ করছেন তাদের উদ্যোগও প্রশংসনীয়। এসব প্রচেষ্টা সরকারের উদ্যোগ বাস্তবায়নের দিকে নিয়ে যাবে।
বাংলাদেশে গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না থাকলেও জাতীয়ভাবে পালিত হচ্ছে গণহত্যা দিবস। ১১ মার্চ, ২০১৭ তারিখে, সংসদ সর্বসম্মতিক্রমে ২৫ মার্চকে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসাবে ঘোষণা করার বিষয়টি গ্রহণ করে। সংসদে উত্থাপিত রেজুলেশনে বলা হয়, “পার্লামেন্টের অভিমত হলো, ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা উচিত ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যার স্মরণে এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করা।
পরে ওই বছরের মার্চে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীসহ অনেকেই জাতিসংঘে ২৫ মার্চকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির প্রস্তাব ঘোষণা করেন। তবে এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। প্রসঙ্গত, গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর বিশ্বের বৃহত্তম গণহত্যা বিশেষজ্ঞ সংস্থা আমেরিকান সংস্থা লেমকিন ইনস্টিটিউট ফর জেনোসাইড প্রিভেনশন ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের গণহত্যাকে স্বীকৃতি দেয়। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সাংবাদিক সিরাজউদ্দিন হোসেনের ছেলে তৌহিদ রেজা নূরের করা আবেদন যাচাই-বাছাই শেষে এ স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, আর্জেন্টিনা, হংকং, পোল্যান্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অনেক বিদেশী গবেষকও একাত্তরের গণহত্যা নিয়ে গবেষণা করছেন। দেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ নামে একটি কোর্স চালু হয়েছে। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বিভিন্ন শর্ট কোর্স ও আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করে থাকে।